সালাতে প্রচলিত ভুল-ত্রুটি



ঈমান আনবার পর একজন মু’মিনের জন্য সবচাইতে জরুরি কাজ সালাত আদায় করা। সালাতের ফরয,ওয়াজিব,সুন্নাহ এবং সালাতের পূর্বাপর বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে যথাসম্ভব নির্ভুল পদ্ধতিতে আদায় করা একজন মু’মিনের জন্য বাঞ্ছনীয়।

এ লেখাটিতে এমন কিছু ভুল-ত্রুটির উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো মুসল্লিদের মাঝে অধিক লক্ষণীয়; এবং যেসব থেকে বেঁচে থাকা অতীব জরুরি। লেখাটিতে ফিকহি মতপার্থক্য এড়িয়ে কেবলমাত্র সর্বসম্মত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

১. তাড়াহুড়া করে ওযু করা: জামা’আতে শরীক হওয়ার জন্যে তাড়াহুড়া করে ওযু করার কারণে অনেক সময় কোন কোন স্থানে পানি পৌঁছে না। শুকনো রয়ে যায় বিভিন্ন অঙ্গের কোন কোন স্থান। অথচ কোন স্থান শুকনো থেকে গেলে সেই ওযু দিয়ে সালাত বিশুদ্ধ হবে না।

২. পেশাব ও পায়খানার চাপ রেখে সালাত আদায় করা: রাসূল ﷺ বলেন,
‘খাদ্য উপস্থিত হলে এবং দুটি নাপাক বস্তুর (পেশাব-পায়খানা) চাপ থাকলে সালাত হবে না।’ (মুসলিম হা/৮৬৯)

৩. দ্রুততার সাথে দৌড়িয়ে সালাতে শরীক হওয়া:  ইমামের সাথে তাকবীরে তাহ্‌রীমা পাওয়ার জন্য বা রুকু পাওয়ার জন্য দৌড়িয়ে বা দ্রুত হেঁটে সালাতে শামিল হওয়া যাবে না।এটা নিষিদ্ধ। রাসূল ﷺ বলেন,
‘যখন সালাতের ইক্বামত প্রদান করা হয় তখন তাড়াহুড়া করে সালাতের দিকে আসবে না। বরং ধীর-স্থির এবং প্রশান্তির সাথে হেঁটে হেঁটে আগমন করবে। অতঃপর যতটুকু অংশ পাবে তা আদায় করবে। আর যা ছুটে যাবে তা (ইমামের সালামের পর) পূর্ণ করে নিবে।’ (বুখারী হা/৮৫৭ ; মুসলিম)

৪. কাতারে আঁকাবাঁকা হয়ে দাঁড়ানো, ফাঁকা ফাঁকা হয়ে দাঁড়ানো এবং সামনের কাতার আগে পূর্ণ না করা: নু’মান বিন্‌ বাশীর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল ﷺ নিয়মিত আমাদের কাতারগুলো সোজা করতেন যেন তিনি তীর সোজা করছেন। যতক্ষণ না তিনি বুঝলেন, আমরা ব্যাপারটি বুঝে ফেলেছি। একদা তিনি নামাযের তাকবীর দিবেন দিবেন এমতাবস্থায় দেখলেন, জনৈক সাহাবীর ছাতি অন্যদের তুলনায় একটু সামনের দিকে বের হয়ে আছে তখন তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘তোমরা নামাযের কাতারগুলো সোজা করবে। নয় তো আল্লাহ্‌ তা’আলা তোমাদের মাঝে ভিন্নতা সৃষ্টি করবেন।’ (বুখারী হা/৭১৭, মুসলিম হা/৪৩৬)
আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, নবী ﷺ বলেন: অনুসরণ করার জন্যই ইমাম নির্ধারণ করা হয়। ...... আর তোমরা সালাতে কাতার সোজা করে নিবে, কেননা কাতার সোজা করা সালাতের সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত। (বুখারী হা/৬৮৬)
জাবের ইবনে সামুরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেন: ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের দরবারে যেভাবে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হয়ে থাকে তোমরা ঐরূপ করো না কেন? আমরা জিজ্ঞেস করি, ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের দরবারে কিভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়? তিনি বলেন ﷺ: তারা সবার আগে প্রথম কাতার পূর্ণ করে, অতঃপর পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় কাতার ইত্যাদি পূর্ণ করে এবং তারা কাতারে দণ্ডায়মান হওয়ার সময় পরস্পর মিলে দাঁড়ায়। (আবু দাউদ হা/৬৬১, মুসলিম, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)
আনাস ইবনে মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ ﷺ বলেছেন: তোমরা কাতারের মধ্যে পরস্পর মিলে মিশে দাঁড়াও, এক কাতার অপর কাতারের নিকটে করো এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও। যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ! আমি শয়তানকে নামাযের কাতারের মধ্যে বকরীর ন্যায় প্রবেশ করতে দেখেছি। (আবু দাউদ হা/৬৬৭, নাসাঈ)

৫. সিজদার স্থানে দৃষ্টিপাত না করে এদিক-ওদিক তাকানো ও আকাশের দিকে তাকানো: আকাশের দিকে বা অন্য দিকে দৃষ্টিপাত করার ফলে সালাতে ভুল হয়ে যায় এবং মনের মাঝে নানা কথার সৃষ্টি হয়। অথচ দৃষ্টি নীচে রাখা এবং সার্বক্ষণিক দৃষ্টি সিজদার স্থানে রাখার জন্য নির্দেশ রয়েছে। নবী ﷺ বলেন, ‘কিছু লোকের কি হয়েছে, তারা সালাতরত অবস্থায় আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে?’ তারপর তিনি কঠোর শব্দ উচ্চারণ করে বলেন, ‘তারা হয় এ থেকে বিরত হবে, নইলে তাদের দৃষ্টি শক্তি ছিনিয়ে নেয়া হবে।’ (মুসলিম ; মিশকাত হা/৯৮৩)
সালাত অবস্থায় ডানে-বামে দৃষ্টিপাতের ব্যাপারে নবী ﷺ -কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে বান্দার সালাত থেকে কিছু অংশ শয়তানের ছিনিয়ে নেয়া।’ (বুখারী ; মিশকাত হা/৯৮২)

৬. বিনা কারণে চোখ বন্ধ করে সালাত আদায় করা: ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ্‌মাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, ‘সালাত অবস্থায় দু’চোখ বন্ধ রাখা নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হিদায়াত বহির্ভূত কাজ।’

৭. তাকবীর, কুর’আন তেলাওয়াত ও সালাতের অন্যান্য দু’আর সময় ঠোঁট না নাড়িয়ে শুধু মনে মনে বলা: এটি একটি বহুল প্রচলিত ভুল। ইমাম নববী (রহ্‌মাতুল্লাহি ‘আলাইহি) বলেন, ‘ইমাম ছাড়া অন্য সবার সর্বনিম্ন সীমা হচ্ছে নিজেকে শোনানো- যদি তার শ্রবণ শক্তি ঠিক থাকে এবং কথায় কোন জড়তা না থাকে। এ বিধান সকল ক্ষেত্রে ক্বিরাত পাঠ, তাকবীর, রুকু, সিজদার তাসবীহ প্রভৃতি।’ তাছাড়া ঠোঁট না নাড়ালে তো সেটাকে পড়া বলা চলে না। কারণ আরবীতে এমন অনেক অক্ষর আছে ঠোঁট না নাড়ালে যার উচ্চারণই হবে না।

৮. তাকবীর দেওয়ার সময় হাত উত্তোলন প্রসঙ্গে: অনেককে দেখা যায় তাকবীর দিয়ে হাত দুটি উত্তোলনের সময় হাতের তালু বাঁকা রাখেন, অথবা কান ধরেন। অথচ হাতের তালুদ্বয় ক্বিব্‌লামুখী রাখাটাই সুন্নাহ। দু’হাত ওঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ আঙ্গুলগুলোকে প্রসারিত অবস্থায় ওঠাতেন। তবে আঙ্গুলের মাঝে তিনি ফাঁক রাখতেন না এবং একেবারে মিলিয়েও দিতেন না।(আবু দাউদ, ইবনু খুযায়মাহ, তামামুল মিন্‌নাহ এবং হাকিম একে সহীহ বলেছেন ও যাহাবী তার সমর্থন দিয়েছেন।) নাবী ﷺ কানের লতি বরাবর হাত উঠাতেন(মুসলিম, ইবনে মাজাহ, নাসাঈ ও আবু দাউদ)। কিন্তু কান স্পর্শ করার দলিল কোথাও পাওয়া যায় না।

৯. ক্বিরা’আত প্রসঙ্গে: সলাতে সূরা পাঠ বিশেষ করে সূরা ফাতিহা পাঠ করার সময় আয়াতসমূহের শেষে ওয়াক্বফ্‌ করা অর্থাৎ প্রতি আয়াতে থেমে থেমে ক্বিরা’আত করা সুন্নাত। (আবু দাউদ, সাহমী (৬৪-৬৫) হাকিম এটিকে সহীহ বলেছেন ও যাহাবী তার সমর্থন করেছেন, আবু আমরুদ্দিন এটিকে ‘আল-মুক্‌তাফা’ তে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, ‘এ হাদিসের অনেকগুলো সূত্র রয়েছে। তবে এ বিষয়ে এটিই মূল।)
এছাড়াও, ক্বিরা’আত শুদ্ধ করে পড়া সকলের উপর ফরয।
নবী ﷺ ক্বিরা’আত শেষে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে একটু বিরাম নিতেন। (আবু দাউদ, হাকিম একে সহীহ বলেছেন ও যাহাবী তাতে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এই বিরামের পরিমাণ ইবনুল কায়্যিম ও অন্যান্যগণ নির্ণয় করেন যে, এটা একবার শ্বাস নেওয়ার সম পরিমাণ।)

১০. রুকু প্রসঙ্গে: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘তোমাদের কারো সলাত ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুযায়ী ভালভাবে ওযূ করবে অতঃপর আল্লাহু আক্‌বার বলে তাঁর প্রশংসা ও মহত্বের গুণকীর্তন করবে এবং কুর’আন থেকে আল্লাহ্‌র শিখানো ও অনুমোদিত অংশ হতে যা সহজ তা পাঠ করবে। অতঃপর তাকবীর বলে রুকু করবে ও এমতাবস্থায় স্বীয় হস্তদ্বয় উভয় হাঁটুর উপর স্থাপন করবে- যাতে দেহের জোড়াগুলো শান্তশিষ্ট ও স্থির হয়ে যায়...... (আবু দাউদ ও নাসাঈ, হাকিম একে সহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তার সমর্থন করেছেন।) তিনি ﷺ রুকুকালে নিজের হাটুঁদ্বয়ের উপর দু’হাত রাখতেন (বুখারী ও আবু দাউদ)। এবং তিনি এজন্য নির্দেশ দিতেন (বুখারী ও মুসলিম)। তিনি তাঁর আঙ্গুলগুলোর মাঝে ফাঁকা রাখতেন(বুখারী ও আবু দাউদ)। দু’হাতকে হাঁটুর উপর স্থাপন করতেন;দুই হাঁটুকে আঁকড়ে ধরার মত করে (হাকিম এবং তিনি একে সহীহ বলেছেন এবং যাহাবী ও তায়ালুসী ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এটি আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে)। এ বিষয়ে তিনি সলাতে ত্রুটিকারীকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘যখন তুমি রুকু করবে তখন তোমার দু’হাত উভয় হাঁটুর উপর রাখবে এবং আঙ্গুলগুলোর মাঝে ফাঁকা রাখবে অতঃপর এমন সময় পর্যন্ত থামবে যাতে প্রত্যেকটি অঙ্গ স্ব স্ব স্থানে স্থির হতে পারে (সহীহ ইবনু খুযায়মাহ ও সহীহ ইবনু হিব্বান)। তিনি কনুই দু’টোকে পাঁজর থেকে দূরে রাখতেন (তিরমিযী এবং ইবনু খুযায়মাহ একে সহীহ বলেছেন)। তিনি রুকুকালে পিঠকে সমান করে প্রসারিত করতেন (বায়হাকী-সহীহ সনদে এবং বুখারী)। এমন সমান করতেন যে, তাতে পানি ঢেলে দিলেও তা যেন স্থির থেকে যাবে (তাবারানী ‘আল-কাবীর’ ও ‘আস-সগীর’ গ্রন্থে এবং আবদুল্লাহ বিন আহ্‌মাদ ‘যাওয়াইদুল মুসনাদ’ গ্রন্থে ও ইবনু মাজাহ)। তিনি পিঠ অপেক্ষা মাথা উঁচু বা নীচু রাখতেন না (আবু দাউদ ও বুখারী সহীহ সনদে জুযউল ক্বিরা’আত গ্রন্থে)। বরং তা মাঝামাঝি থাকত (মুসলিম ও আবু আওয়ানাহ)।

১১. দাঁড়ানো ও বসাবস্থায় পিঠ সোজা না রাখা: যেমন পিঠ কুঁজো করে রাখা বা ডানে-বামে হেলে থাকা। রাসূল ﷺ বলেন, ‘যে রুকু ও সিজদায় পিঠ সোজা করে না, আল্লাহ্‌ তার সালাতের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। (তাবারানী- সহীহ সনদে) তিনি আরো বলেন,
‘তোমরা রুকু ও সিজদা পরিপূর্ণরূপে আদায় কর।’ (বুখারী হা/৬১৫৩ ও মুসলিম হা/৬৪৫)

১২. রুকু ও সাজদায় প্রশান্তি ও ধীর-স্থিরতা অবলম্বন না করা:
 দেখা যায়, অনেক মানুষ তাড়াহুড়া করে সালাত আদায় করতে গিয়ে ভালভাবে রুকু-সিজদা করে না। রুকুর সময় পিঠ সোজা না করে মাথাটা একটু নিচু করে। মোরগের ঠোকর দেয়ার মত করে সিজদা করে। অথচ এভাবে সালাত আদায়কারীকে হাদিসে নিকৃষ্ট চোর বলা হয়েছে। (আহ্‌মাদ ; মিশকাত হা/৮৮৫) আর তার সালাতও বিশুদ্ধ হবে না। যায়দ বিন ওয়াহাব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযায়ফাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) দেখলেন জনৈক ব্যক্তি অপূর্ণরূপে রুকু-সিজদা করছে। তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি তো সালাত আদায় করনি। তুমি যদি এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ কর, তবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আল্লাহ্‌ যে ফিত্‌রাত (বা বৈশিষ্ট্য বা ইসলাম) দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তুমি তা ভিন্ন অন্য ফিত্‌রাতের উপর মৃত্যুবরণ করবে।’ (বুখারী ও মুসলিম ; মিশকাত হা/৮৮৪)
নবী ﷺ থেকে আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন। তিনি দেখলেন, এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে (দ্রুত) সালাত আদায় করল। তখন নবী ﷺ তাকে বললেন, ‘তুমি ফিরে গিয়ে সালাত আদায় কর। কেননা তুমি সালাতই আদায় করনি।’ (বুখারী হা/৭৫১)
রাসূল ﷺ এক ব্যক্তিকে সলাত রত অবস্থায় দেখতে পেলেন, সে তার রুকু পূর্ণভাবে আদায় করছে না এবং সাজদায় ঠোকর দিচ্ছে। তিনি বললেন, ‘যদি এই ব্যক্তি তার এই অবস্থায় মারা যায় তবে সে মুহাম্মাদ ﷺ-এর ধর্মের উপর মারা যাবে না। কাক যেমন রক্তের মধ্যে ঠোকর দিয়ে থাকে সেও তদ্রূপ তার সলাতে ঠোকর দিচ্ছে। যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে রুকু করে না এবং সাজদায় ঠোকর দেয় তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ ক্ষুধার্তের ন্যায় যে একটি অথবা দু’টি খেজুর খায় কিন্তু তাতে মোটেও তার ক্ষুধা নিবারণ হয় না।’ (আবু ইয়ালা স্বীয় মুসনাদে, আজুররী ‘আরবাইন’ গ্রন্থে, বায়হাকী ও তাবারানী, আয্‌যিয়া ‘আল-মুনতাকা মিনাল আহাদিসিস সিহাহ ওয়াল হিসান গ্রন্থে, ইবনু আসাকির হাসান সনদে। একে ইবনু খুযায়মাহ সহীহ বলেছেন। হাদিসের অতিরিক্ত অংশ ছাড়া প্রথম অংশের উপর মুরসাল সনদে শাহিদ (সাক্ষ্যমূলক) বর্ণনা পাওয়া যায় যা ইবনু বাত্ত্বাহ এর ‘আল-ইবানাহ’ গ্রন্থে রয়েছে।)
নবী ﷺ এক সময় সলাত পড়া অবস্থায় আড় চোখে একটি লোককে দেখতে পেলেন যে, সে তার মেরুদণ্ডকে রুকু ও সাজদায় সোজা করছেনা। সলাত শেষে তিনি বললেন, ‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! যে ব্যক্তি রুকু ও সাজদায় স্বীয় মেরুদণ্ডকে সোজা করেনা তার কোন প্রকার সলাত হবে না।’ (ইবনু আবী শাইবাহ, ইবনু মাজাহ ও আহ্‌মাদ- সহীহ সনদে)
রুকু ও সাজদাহ পরিপূর্ণ করার জন্য রুকু হতে সোজা হয়ে দাঁড়ানো ও দুই সাজদার মাঝে সোজা হয়ে বসাও এর অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ আবশ্যক (ওয়াজিব)। যদিও অনেক মুসল্লিদের দেখা যায় তারা রুকু হতে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই সাজদায় গমন করে এবং দুই সাজদার মাঝখানে সোজা হয়ে বসেন না। উল্লেখ্য যে, ওয়াজিব তরক করার কারণে তাদের সালাত পূর্ণ হবে না। 

১৩. সালাতে সিজদা করার সময় সাতটি অঙ্গ পরিপূর্ণরূপে মাটিতে না রাখা: আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ﷺ  সাতটি অঙ্গের উপর সিজদা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। মুখমণ্ডল (নাক ও কপাল), দুই হাত, দুই হাঁটু ও দুই পা। (বুখারী ; মিশকাত হা/৮৮৭) কিছু লোক সিজদা করার সময় দু’টি পা সামান্য একটু উঠিয়ে রাখে বা এক পা অন্যটির উপর রাখে। বরং সুন্নাহ হচ্ছে দু’পায়ের আঙ্গুলসমূহ কিবলামূখী করে রাখা। অনুরূপভাবে কেউ কেউ শুধু কপাল মাটিতে রাখে, নাক রাখে না। এরূপ করা সুন্নাহের পরিপন্থী।

১৪. দু’দিকে সালাম ফিরানোর সময় মাথা ঝাঁকানো বা পরিপূর্ণ ভাবে চেহারা না ঘুরানো: লক্ষ্য করা যায় কিছু মুসল্লী সালাম ফিরানোর সময় মাথাটা একটু উপর দিকে উঠিয়ে আবার নীচে নামায়। আবার অনেকে মাথা সম্পূর্ণভাবে ডান ও বাম দিকে ঘুরায় না। ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ ডান দিকে সালাম ফিরানোর সময় বলতেন, আস্‌-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্‌মাতুল্লাহ। সে সময় তাঁর ডান গালের শুভ্র অংশ পিছন থেকে দেখা যেত। আর বাম দিকে সালাম ফিরানোর সময় বলতেন, আস্‌-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্‌মাতুল্লাহ। সে সময় তাঁর বাম গালের শুভ্র অংশ দেখা যেত। (তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ, মিশকাত হা/৯৫০, সনদ সহীহ)

১৫. সরাসরি ইমামের সাথে সালাতে শরীক না হয়ে অপেক্ষা করা: অর্থাৎ ইমাম সিজদায় থাকলে বসার অপেক্ষা করা বা বসাবস্থায় থাকলে দাঁড়ানোর অপেক্ষা করা। তিনি যখন দাঁড়াবেন বা রুকু’তে যাবেন তখন তাঁর সাথে সালাতে শামিল হওয়া। এটা সুন্নাত বহির্ভূত কাজ। বরং ইমাম যে অবস্থাতেই থাকুন তার সাথে সালাতে শরীক হতে হবে।
মুআ’য বিন জাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেন, 'তোমাদের কেউ যদি সালাতে উপস্থিত হয়ে ইমামকে কোন অবস্থায় পায় তবে সেভাবেই তার সাথে সালাতে শরীক হবে ইমাম যেভাবে থাকেন।’ (তিরমিযী হা/৫৩৯; সনদ সহীহ)

১৬. ইমামের আগে কোন কাজ করা: যেমন ইমামের আগেই রুকু’ সিজদা করা বা দাঁড়িয়ে পড়া ইত্যাদি। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অনেকে এরূপ করে ফেলে। অথচ উচিত ছিল ধীরস্থিরভাবে ইমামের পরে পরে এ সমস্ত কাজ করা। কেননা, এক্ষেত্রে হাদিসে কঠিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘তোমাদের কোন ব্যক্তি কি এ ভয় করে না যে, যখন ইমামের আগে সে মাথা উঠাবে, তখন হতে পারে আল্লাহ্‌ তার মাথাটা গাধার মাথায় পরিবর্তন করে দিবেন অথবা তার আকৃতিকে গাধার আকৃতিতে পরিবর্তন করে দিবেন?’ (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১১৩৮, ১১৪১)
এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সতর্কতার বিষয় হল, সালাম ফিরানোর সময় ইমামের সালাম ফিরানো শেষ করার পর মুক্তাদি সালাম ফেরাবে।

১৭. কোন সুতরা ছাড়াই সালাত আদায় করা: অধিকাংশ মানুষ কোন পরওয়া না করে যেখানে সেখানে সালাত আদায় করার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। সুন্নাত হচ্ছে, কোন সুতরা সামনে রাখা। অর্থাৎ কমপক্ষে অর্ধ হাত বরাবর কোন উচু বস্তু সামনে সালাতে দাঁড়ানো উচিত। আলেমদের মধ্যে অনেকে সুতরা গ্রহণ করা ওয়াজিব বলেছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘সুতরা ব্যতীত সালাত আদায় করবে না, আর তোমরা সম্মুখ দিয়ে কাউকে অতিক্রম করতে দিবে না, যদি সে অগ্রাহ্য করে তবে তার সাথে লড়াই করবে, কেননা তার সাথে ক্বারীন (শয়তান) রয়েছে।’ (বুখারী হা/৫০৯; মুসলিম হা/৫০৫, ৫০৬; ইবনু খুযায়মা, হাকেম ও বায়হাক্বী)

১৮. সালাতরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে হাঁটা চলা করা: এ বিষয়ে অনেক মানুষ শিথিলতা প্রদর্শন করে থাকে। অথচ এক্ষেত্রে কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আবুল জুহাইম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন,
‘সালাতের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রমকারী যদি জানত এতে কি পরিমাণ পাপ রয়েছে, তবে তার সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করার চাইতে চল্লিশ (দিন/মাস/বছর) দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম হত।’ হাদিসের বর্ণনাকারী আবু নযর বলেন, আমার মনে পড়ে না- চল্লিশ দিন না চল্লিশ মাস না চল্লিশ বছর বলেছেন। (বুখারী হা/৪৮০)

১৯. নামাযের ভিতর বিনা প্রয়োজনে কোন কাজ করা এবং বেশি বেশি নড়াচড়া করা: আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন: 
‘‘তোমরা আল্লাহ্‌র জন্য অনুগত হয়ে দাঁড়াও।’’ (সূরাহ আল-বাক্বারাহ ২৩৮)
‘‘নিশ্চয়ই সেই সকল মু’মিন বান্দা সফলকাম হবে। যারা নিজেদের নামাযে বিনীত থাকে।’’ (সূরাহ আল-মু’মিনূন ১-২)
রাসূলুল্লাহ ﷺ–কে সিজদার মধ্যে মাটি সমান করা যাবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন: ‘নামায অবস্থায় তুমি কিছু মুছতে পারবে না। একান্তই যদি প্রয়োজনে কিছু করতে হয় তাহলে (সিজদার স্থান থেকে) কংকরাদি মাত্র একবার সরিয়ে দিতে পারবে।’ (মুসলিম, আবূ দাঊদ ১/৫৮১, সহীহুল জামে হা/৭৪৫২)
আলেমগণ বলেছেন, নামাযের ভিতর বিনা প্রয়োজনে বেশি মাত্রায় একাধারে নড়াচড়া করলে নামায বাতিল হয়ে যাবে। অতএব যারা নামাযে বিনা কারণে বেশি নড়াচড়া ও খেলায় মেতে উঠে তাদের অবস্থা কেমন হতে পারে একবার চিন্তার বিষয়। সুতরাং, আমাদের সকলের কর্তব্য হচ্ছে নামাযে বিনীত হয়ে দাঁড়িয়ে ধীরতা ও সুস্থতার সাথে অর্থাৎ পরিপূর্ণ খুশু’-খুযূর সাথে নামায আদায় করা।

২০. ফরয সালাতের এক্বামত হওয়ার পরও নফল বা সুন্নাত আদায় করতে থাকা: অনেক মানুষ সুন্নাত বিরোধী এ কাজটি করে থাকে। আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন, ‘যখন সালাতের ইক্বামত দিয়ে দেয়া হয়, তখন সেই ফরয সালাত ব্যতীত আর কোন সালাত নেই।’(মুসলিম, তিরমিযী হা/১৪৩, নাসাঈ, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ)
ইবনু হযম (রহ্‌মাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, ফরয সালাতের ইক্বামত হয়ে যাওয়ার পর যদি কেহ সুন্নাত সালাত শুরু করে, আর এ কারণে তার তাকবীর বা এক রাকাত ছুটে যায় তবে উক্ত সুন্নাত শুরু করা তার জন্য জায়েয নয় এবং এ অবস্থায় সে আল্লাহ্‌র নাফরমান বলে গণ্য হবে।
অতএব, যখনই জামা’আতে সালাত চলমান দেখবে তখনই মুসল্লীর কর্তব্য হল কোন প্রকার সুন্নাতের নিয়ত না করে সঙ্গে সঙ্গে জামা’আতে শরীক হয়ে যাওয়া।

২১. সালাতরত অবস্থায় হাই প্রতিরোধ না করা: রাসূল ﷺ বলেন, 
‘তোমাদের কোন ব্যক্তির সালাত অবস্থায় যদি হাই আসে তবে সাধ্যানুযায়ী তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। কেননা ঐ অবস্থায় শয়তান ভিতরে প্রবেশ করে।’ (মুসলিম হা/৫৩১৩) এটা প্রতিরোধ করার পদ্ধতি হচ্ছে, ঐ অবস্থায় মুখে হাত দেয়া।

২২. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা ও সিজদায় কাপড় উপরে উঠে যাওয়া: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘‘৩ প্রকার লোকের সাথে আল্লাহ্‌ তা’আলা ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না। তাদেরকে পবিত্র করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি। তারা হল টাখনুর নীচে কাপড় (অন্য বর্ণনায় লুঙ্গি) পরিধান কারী, খোঁটা দানকারী (অন্য বর্ণনায় এসেছে যে খোঁটা না দিয়ে কাউকে কোন কিছু দান করে না) ও মিথ্যা শপথের সাহায্যে পণ্য সামগ্রী বিক্রয়কারী।’’ (মুসলিম ১/১০২)
নামাযের মধ্যে হোক কিংবা নামাযের বাইরে, অহংকারের সাথে হোক কিংবা অহংকার ছাড়া; সর্বাবস্থায় টাখনুর নীচে কাপড় পরিধান করা হারাম। কেননা আল্লাহ্‌র রাসূল ﷺ বলেছেন:
‘‘টাখনুর নীচে কাপড়ের যে টুকু থাকবে তা জাহান্নামে যাবে।’’ (মুস্‌নাদে আহ্‌মাদ ৬/২৫৪, সহীহুল জামে হা/৫৫৭১)
এছাড়াও দেখা যায় যে,কিছু কিছু মুসল্লি ভাইয়েরা এতো ছোট,আঁটোসাঁটো শার্ট/গেঞ্জি পড়ে সালাত আদায় করেন যে সিজদায় গেলে তাদের কাপড়ের পেছনের অংশ উপরে উঠে যায় এবং যার ফলে তাদের সতর ভঙ্গ হয়,যেটা দৃষ্টিকটু এবং মহান আল্লাহ তায়ালার সামনে যারপরনাই বেয়াদবি। আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা আমাদের বিশুদ্ধ ও সুন্নাহ মোতাবেক সালাত আদায়ে সাহায্য করুন।আমিন।
মুল সংকলক: হোসনি তাহসিন;পরিমার্জন ও পরিবর্ধনে: আরমান ইবনে সোলাইমান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ