আমি মানুষ নই, আমার নাম লাশ




মানুষ হিসেবে আমার মন খুব একটা বড় আকৃতির না। ফলাফল- এই এক জীবনে তৈরি করা ভালোবাসার মানুষদের তালিকার সাইজ অতি ক্ষুদ্র। এ তালিকার মোটামুটি শীর্ষে অবস্থানকারী একজন মানুষ ছিলেন আমার নানু।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দিনগুলো আসলেই আমার গা শিউরে উঠে। সেদিনটাও ঠিক এমন ছিল। ভোরের আলো পুরোপুরি ফোটেনি। হাসপাতালের কেবিনের সামনে অস্থির পায়চারি করছি আমরা। নানুর অবস্থার ক্রমশ: অবনতি হচ্ছে। যে ক্লিনিকে তিনি ভর্তি তাতে আইসিইউ নেই। রাস্তার অপরপ্রান্তের হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। ভোরবেলা, হাসপাতালের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আর মামা অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করছি।
একবার এই হসপিটাল আরেকবার অন্যটাতে। শেষমেষ কয়েকজনকে ডেকেডুকে হাতেপায়ে ধরে ম্যনেজ করা গেল। ফর্ম পুরন শেষে ধরাধরি করে তাকে স্ট্রেচারে তোলা হল, নাকে ছোট বহনযোগ্য অক্সিজেন সিলিন্ডার। নানুর চোখ বন্ধ। হাত নেড়ে নাকের অক্সিজেন মাস্কে হাত দিলেন বলে মনে হল কয়েকবার। রাস্তার ওপারের হসপিটালে নিতে সময় লাগলো বড়জোর ১ থেকে দেড় মিনিট।

শোয়ানোর সাথে সাথেই ডাক্তার পরীক্ষা করে ঘোষণা দিলেন- নানু আর নেই। আমরা কথাটা হজম করতে পারলাম না। বিশ্বাস করলাম না কেউ। এইমাত্র দেখলাম হাত নাড়লো, কী বলে ডাক্তার এইসব? আরেকটু দেখা যায় না? আছে তো মনে হয়। ডাক্তার প্রকান্ড জটিল মেশিনের স্ক্রিনে কি কি সব দেখিয়ে কোন কিছু একটা বোঝাচ্ছেন মামাকে। দরজার ওপাশে আম্মা দেওয়ালে হেলে পড়েছেন কান্নায়। আব্বার দিকে তাকালাম না। আমি সম্মোহিতের মতো দেয়াল ধরে ধরে কোনরকমে দোতলা থেকে নিচের রাস্তায় নেমে গেলাম। নায়কের মন খারাপের সময়গুলোতে সিনেমায় যেমনভাবে বৃষ্টি নামে ঠিক তেমনভাবে আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝুপ করে বৃষ্টি নামল। আমি গরম পানির ফ্লাস্ক আর কাপড়ের পলিব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টির সময় নাকি দু’আ কবুল হয়। প্রানপণে দু’আ করতে লাগলাম- হে আর-রাহমান! এটা যেন স্রেফ স্রেফ একটা স্বপ্ন হয়। ঘুম ভাঙতেই দেখা যাবে আমার বক্স খাটটাতে আমি গুটিসুটি ঘুমুচ্ছি, বিদ্যুত নেই, গরমে ঘামছি আর স্বপ্ন দেখে ভয়ে অস্থির হচ্ছি। 

মূর্খের মতো অবাস্তব দু’আ কবুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার দু’আ কবুল হল না। ওপাশের চায়ের দোকানের ছেলেটা কেটলিতে পানি ফুটোতে দিয়ে দোকানের সামনের রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে, এপাশে একজন সস্তা চাইনিজ মোবাইলে কোন একটা গান চালানোর চেষ্টা করছেন, প্রিয় গান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শোঁ শোঁ করে অনেকক্ষন পর পর একটা কি দুটো গাড়ি চলে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়াটার সাথে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গালে বিঁধতে লাগলো কাঁটার মতো। ভোরের রহস্যময় আলোর সাথে মেঘের রঙটা মিলেমিশে তৈরি করল আমার জীবনের সবচাইতে ভয়াবহ মন খারাপের দিনটা।

জীবনটা এত্ত সস্তা? এইমাত্র দেখা মানুষটা এখন আর নেই? জাস্ট আ ফ্রাকশন অফ সেকেন্ড? বুম!! সব শেষ? জলজ্যন্ত একটা প্রাণ পৃথিবী থেকে চলে গেল, হারিয়ে গেল।আর কোনদিন তার ভালোবাসার অত্যাচার আমাদের জর্জরিত করবে না, কোনদিন খাইসস কিছু? শুকায় চেহারা-সুরুত কি হইছে দেখছস? বলে চিন্তিত মুখে দুনিয়ার খাবার এনে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে না কেউ, তার ভয়াবহ ভালোবাসার পাহাড়টা আমাদের উপর চাপিয়ে আমাদের আর অস্থির করে তুলবে না। কীভাবে সম্ভব? কেন হয় এমন?   পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ যে যার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে-কারো কিসসু এসে যাচ্ছে না। যে যার যার মতো করে কেটলিতে পানি ফুটিয়ে রাস্তা ঝাড় দিচ্ছে অথবা মোবাইলে গান ছেড়ে নিজের আত্মার খোরাক খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছে। খুব খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সেদিন চিৎকার করে সবাইকে বলি- তামশা কর? একটা মানুষ মারা গেছে। কিচ্ছু এসে যায় না নাকি? কিচ্ছু না?

এ পৃথিবীর সবচাইতে বড় অবিশ্বাসী মানুষটাও বিশ্বাস করে সে মারা যাবে। তবু তার প্রানান্ত প্রচেষ্টা থাকে মৃত্যুকে ভুলে যাবার, ভুলে থাকার। আমরা ভুলে যাই মৃত্যুকে যতই আমরা ভুলে থাকি না কেন সে কিন্ত আমাদের ভুলে থাকে না। সে এগিয়ে আসে- আপন গতিতে, আপন সময়ে, আপন ছন্দে। একদিন আমিও এভাবে চলে যাব। কারো তাতে কিসসু এসে যাবে না। রাস্তার ওপারের কেটলিটাতে গরম পানি ধোঁয়া তুলে জানান দিতে থাকবে তার অস্তিত্ব, আর মোবাইল ফোনটা জানান দেবে তার গানের সুরে। আমি শুধু পারব না আমার অস্তিত্বের জানান দিতে। নিশ্চল, নিশ্চুপ এক জড় পদার্থ কেবল আমি। তখন আর আমি মানুষ নই, আমার নাম লাশ…….. 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ