জঙ্গি তৈরির কারখানা

‘মাদরাসা বন্ধ করতে হবে’ বা এটি ‘জঙ্গি তৈরির কারখানা’ জাতীয় অখাদ্য শ্রেণির উক্তি ইদানিং বাজারে বেশ চলছে। বাংলাদেশের একটি নিয়ম হচ্ছে কোন কাজ আমলে পরিবর্তন করার পূর্বে সেটা নিয়ে বারবার বিতর্ক তৈরি করা। একটা মিথ্যাকে হাজারবার শুনিয়ে কানকে অভ্যস্ত করে মানুষের চামড়ায় সইয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। একবার অভ্যাস হয়ে গেলেই খালাস- দুম করে এবার করে ফেললেই হল। এসবের যিকরকারী কারা তা লিখে প্রকাশ করার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করছি না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া বা এজাতীয় ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভেবে নিয়ে যারা বোকার রাজ্যে বসবাস করছেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি- আপনারা অতি ভয়াবহ একটা রাজ্যে বসবাস করছেন। এ রাজ্য চিন্তার আলস্যতার রাজ্য। প্রতিবন্ধীত্বতার তাঁরকাটার খুব কাছাকাছি।
চোখ-কান-নাক যারা খোলা রেখে চলেন তারা হয়তো জেনে থাকবেন-- ঘটনার মাত্র কয়েকটাদিন আগে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই দুটি মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং যার মধ্যে একটি মাদরাসায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় প্রশাসন থেকেই। এসব ঘটনায় খুব একটা সুবিধা করতে না পেরেই এর মাত্র কয়েকদিনের মাথায় জামিয়া ইউনুসিয়ায় হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া একটি ছাত্রকে। দুঃখিত, ভুল বললাম। ছাত্র নয়। মাদরাসা ছাত্র। এরা ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয় বলে এরা ছাত্র নয়। অন্যকিছু। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিক্ষা দিয়ে ফার্স্ট হলেও এরা এদের ভালো সাবজেক্ট দেওয়া যাবে না, কারণ এরা তো ছাত্র নয়, মাদরাসা ছাত্র। ঘটনাটা এমন- একই কাজ তুমি করলে ‘শিল্পকলা’ আর আমি করলে ‘কাঁচকলা’। শুধু কাঁচকলা না, পোকে ধরা কাঁচকলা। হয়তো এর কারণ এই যে তুমি তথাকথিত আধুনিকতার(?) খাঁচাটা থেকে বহু-বহু-দূরে। তুমি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কখনো মেয়ে দেখে টিজ করতে পারো না, মা-বাবাকে হত্যা করে জেল খাটতে পারো না, নেশা করে গাড়ি চাপায় মানুষটাও মারতে পারো না। ছোঁ...ছোঁ...তুমি এক্কেবারেই আধুনিক নও।
মাদরাসায় হামলা? খটকা লাগছে? কেমন যেন নতুন, অদ্ভুত লাগছে শব্দটা? আমাদের তালেবর মিডিয়াগুলো তো ইয়াআ বড় হেডলাইন লিখেছে(ভিডিওসহ), আমাদের জানিয়ে দিয়েছে মাদরাসা ছাত্রদের ‘তান্ডবের’ গল্প। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মহামূল্যবান খাট-পালঙ্ক ভেঙে গুঁড়াগুড়া করার গল্প। ‘মাদরাসা ছাত্র’ শব্দটার মত করেই তান্ডব শব্দটা এখন এক ও এককভাবে মালিকানা অর্জন করেছে এই ছেলেগুলো। ৫ই মে যে গনহত্যা হয়েছে তাতে নিজের জীবন বাঁচাতে গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করলে তা হয়ে যায় তান্ডব আর তাদের গুলি করে রাস্তায় মেরে ফেলে রাখলে তা কেন যেন হয়ে যায় শিল্প।
ভয়াবহ জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি হলুদ হয়ে যাওয়া খোদ প্রথম আলোর সংবাদেই তারা ভুলবশত বলে ফেলেছে-- আলাউদ্দিন খাঁর ভবনে হামলার সময় টি-শার্ট, জিন্স পড়া কিছু যুবকদের দেখা গেছে। এরা কারা? এদের উদ্দেশ্য কি? এসব রহস্য হয়তো চিরজীবন রহস্যই থেকে যাবে। অপেক্ষা বিচারদিবসের।
মানুষ মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল। আপনি আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রের গায়ে হাত দিলে দেখবেন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ফুসে উঠবে। মেরে কুটে খাবে আপনাকে। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত ছাড় দেয়নি ছাত্ররা। আর মাদরাসায় ঢুকে, তাদের বাসভবনে হামলা চালিয়ে মেরে চলে যাওয়া হবে; আর তারা কিছু না বলে ঘরে বসে চানাচুর ভাজা খাবে এটা ভাবার কারণ আমার জানা নেই। লক্ষণীয় বা মুল পয়েন্ট হওয়া উচিত মাদরাসায় ঢুকে ছাত্রটাকে মারা হয়েছিল, রাস্তায় নয়। তাহলে কেন আলাউদ্দিন খাঁর ঘটনা বারবার আসছে সামনে? কেন ঐতিহ্যবাহি স্থাপনার নাম নিয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করা হচ্ছে? আলাউদ্দিন খাঁ ঐতিহ্যবাহী হলে জামিয়া ইউনুসিয়া, হাটহাজারি এসব মাদরাসাকেও অবশ্যই ঐতিহ্যবাহী বলতে হবে। ঐতিহ্যের সংজ্ঞাটা আসলে কি? এর সীমানাটা বোঝা খুব জরুরি হয়ে পড়ছে আমাদের জন্য।
কেউ যদি অন্যের সম্পদ নষ্ট করে থাকে তা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু একটা দেশে যখন আইনের ক্ষমতা যার হাতে সে-ই যদি কলকাঠি নাড়তে থাকে তখন অসহায় মানুষেরা বাধ্য হবেই ফেটে পড়তে। স্রোতকে যেমন খড়কুটো দিয়ে বেশিক্ষণ আটকে রাখা যায় না, তেমনি দীর্ঘদিনের জুলুম সহ্য করা মানুষদেরও মিথ্যা অপবাদে বেশিদিন শান্ত রাখা যায় না। এদের ক্ষোভ, এদের হতাশা ফেটে বেরোবেই। বেরোতে বাধ্য। এদের ভেতরকার বারুদ আপনারাই তৈরি করেছেন। এতে পুড়তে হবে আপনাদেরই।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই ছেলেগুলোর সাথে তথাকথিক আধুনিক সমাজের সাথে একটা দ্বন্দ্বের সম্পর্ক তৈরি করে অনেক গভীর থেকে শত্রুতা, ঘৃণা তৈরি করা হচ্ছে। অযৌক্তিক মিথ্যা ব্যাখা ও অস্পষ্ট সাংবাদিকতা সুকৌশলে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে ধর্ম ও ঐতিহ্যের মধ্যে, তৈরি করছে ইউনুছিয়া বনাম আলাউদ্দিন খাঁ, গণহত্যা বনাম গাছ উপড়ে ফেলা জাতীয় ইস্যুগুলো। অন্ধ করে দিচ্ছে আমাদের। বারবার। প্রতিবার।
কারো কাছে বিচার চাই না। দেখা হবে সেই সময়ে যেদিন কেউ কেউ বলবে- ইসস! আমি যদি স্রেফ মাটি হয়ে যেতাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ