সেদিন একটি ফটোগ্রাফি কম্পিটিশনে হঠাৎই একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় আমার। তেমন কোন শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ছবি নয়। টিপিক্যাল সম্রাট শাহজাহান সাহেবের তাজমহলের ছবি। ছবির নিচে ক্যাপশন ”Symbol Of Love”.
এরপর থেকেই তাজমহল সম্পর্কিত কিছু বিষয় আমার মাথায় ঘুরঘুর করছে। যার ফলাফল এই লেখাটি।
ছোটবেলা থেকেই তাজমহল ব্যপারটাকে আমরা ভালবাসার মূর্ত প্রতীক হিসেবে জেনে এসেছি। সেই সাথে সাথে জেনেছি সম্রাট শাহজাহানকে একজন মহান প্রেমিক হিসেবে। যিনি নিজ স্ত্রীর জন্য তার ভালোবাসার পদচিহ্ন রেখে গেছেন এ পৃথিবীর বুকে। যা যুগ হতে যুগে মানুষের জন্য হয়ে আছে ভালোবাসার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্বরূপ।
আমরা এই তাজমহলের অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখেছি আর মনে মনে সবাই একবার হলেও জীবনে ভেবেছি একটা মানুষের পক্ষে নিজ স্ত্রীকে কত্তটা ভালবাসা সম্ভব। বাহ! বাহ! কি অসাধারন ! কি মহৎ ছিলেন এই সম্রাট।
কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এই সম্রাট বা তার তাজমহল কি আদৌ এত এত পদবি বা প্রশংসা গ্রহনের যোগ্যতা রাখে? আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ফিরে যাই ইতিহাসে।
তাজমহল তৈরি হয়েছে সারা এশিয়া এবং ভারত থেকে আনা বিভিন্ন উপাদান সামগ্রী দিয়ে। নির্মাণ কাজের সময় ১,০০০ এরও বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল নির্মাণ সামগ্রী বহন করে আনার জন্য। এর নির্মাণে অংশ নিয়েছিল ২০,০০০ এর মত শ্রমিক। আলো-প্রবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে, ইয়াশ্ব্- লাল, হলুদ বা বাদামী রঙের মধ্যম মানের পাথর আনা হয়েছেল পাঞ্জাব থেকে। চীন থেকে আনা হয়েছিল ইয়াশ্ম্- কঠিন, সাদা, সবুজ পাথর, স্ফটিক টুকরা। তিব্বত থেকে বৈদূর্য সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে আনা হয়েছিল নীলকান্তমণি। নীলমণি- উজ্জ্বল নীল রত্ন এসেছিল শ্রীলঙ্কা এবং রক্তিমাভাব, খয়েরি বা সাদা রঙের মূল্যবান পাথর এসেছিল আরব থেকে। এধরণের মোট আটাশ ধরনের মহামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেল পাথরের উপর বসানো হয়েছিল।
তৎকালীন নির্মাণ খরচ অনুমান করা কঠিন ও কিছু সমস্যার কারণে তাজমহল নির্মাণে কত খরচ হয়েছিল তার হিসাবে কিছুটা হেরফের দেখা যায়। তাজমহল নির্মাণে তৎকালীন আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন বা $১০০০০০০ ডলার রুপি খরচ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু শ্রমিকের খরচ, নির্মাণে যে সময় লেগেছে এবং ভিন্ন অর্থনৈতিক যুগের কারণে এর মূল্য অনেক, একে তাই সংখ্যার মাপকাঠিতে বাঁধা সম্ভব নয়। একে তাই অমূল্যই বলা হয়।
এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হল,এতগুলো টাকা এল কোথা থেকে? নিশ্চয় শাহজাহান সাহেব তার নিজের বাবার পকেট থেকে অথবা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কিংবা খেতে-খামারে কামলা খেটে এ টাকাটা জোগাড় করেননি। জী,আপনি ঠিকই ধরেছেন। সেগুলো ছিল সাধারণ মানুষের রক্ত আর ঘামে ভেজা পরিশ্রমের টাকা। এতগুলো টাকা সম্রাটের বাবার সম্পত্তি ছিল না যে কোন এক বিকেলে ঘুম ভেঙ্গে তার মন চাইল আর আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তিনি সেগুলো খরচ করে ফেললেন। তিনি লাখ লাখ মানুষের হক নষ্ট করেছিলেন শুধুমাত্র নিজ প্রমোদ এবং শখ পূরণ করবার জন্য। তার স্ত্রীর প্রাণহীন একটি কবরকে সাজাতে গিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন হাজার হাজার মানুষের জীবন,স্বপ্ন কিংবা তাদের ভবিষ্যতের কবর।
কথিত আছে,এর মুল নকশাকারকদের হাত কেটে নেওয়া হয় এবং কোন কোন ইতিহাসবিদ বলে থাকেন তাদের চোখও উপড়ে ফেলা হয় যাতে করে তারা তাজমহলের নকশা পরবর্তীতে আর নকল করতে না পারেন।
বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, “পাপ বাপকেও ছাড়া না ”।
কথাটির সবচাইতে সুন্দর এবং যথযাথ উদাহরন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খুব সম্ভবত তার পুত্র আওরঙ্গজেব।
১৬৬৬ সালে সম্রাট শাহজাহান তার পুত্রের হাতে বন্দি থাকা অবস্থায় কারাগারেই মৃত্যুবরন করেন। কথিত আছে জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি কারাগারের ছোট জানালা দিয়ে নির্বাক চোখে চেয়ে থাকতেন তার অভিশাপের প্রতীক তাজমহলের দিকে।
শাহজাহানের কারাগার |
প্রকৃতপক্ষে,হাজার হাজার মানুষের অভিশাপ,অসহায় চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে এই মহলটির সাদা মার্বেলের প্রতিটি পরতে পরতে। এই অভিশপ্তপুরী কিভাবে ভালবাসার প্রতীক বা নিদর্শন বলে খ্যাত হতে পারে তা আমার জানা নেই। আমার মতে ”অভিশাপের প্রতীক” ব্যতিত অন্য কোন উপমা এই তাজমহলের জন্য কখনোই কোন অবস্থাতেই যথাযথ হতে পারে না।
0 মন্তব্যসমূহ