ঢাকার মানচিত্রঃ ১৯২৪ |
ক্লাস টু তে পড়ার সময় আমরা সবাই-ই কবি শামসুর রাহমানের একটা কবিতা পড়েছিলাম, ” শহর শহর ঢাকা শহর আজব শহর ঢাকাএই শহরেই আছে অনেক গলি আঁকাবাঁকা”…….
ছোট্ট বয়সটাতেই এ শহরের আঁকাবাঁকা পথ তথা জটিল জীবনটার একটা প্রাথমিক ধারণা আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম কবিতাটিতে। জীবন এখানে জটিলাতায় পরিপূর্ণ। এখানে বাঁচতে হলে সবাইকে রীতিমত যুদ্ধ করেই বাঁচতে হয়। যুদ্ধ করতে হয় জ্যামের সাথে,ধুলোর সাথে,হাই রাইজ খুপরি ঘরের সাথে কিংবা দৈনন্দিন জিনিসের চড়া মুল্যের সাথে।
এইত্ত সেদিনই ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ ঢাকাকে বসবাসের সবচাইতে অযোগ্য নগরী হিসেবে ঘোষণা করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করল। অপরাধের মাত্রার কথাই বলুন আর সাস্থ্যসেবার মানের কথাই বলুন, আমাদের ঢাকা আজ প্রায় এক মৃত নগরীতে পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন ।
এরপরেও কোন এক অজানা কারনে এ শহরটাকে আমরা ঢাকাবাসীরা ভালোবাসি। অযথাই ভালোবাসি। সপ্তাহখানেক বেশী এর বাইরে থাকলেই কেন যেন মৃদু অস্থিরতা বোধ করি ।
হাই রাইজের ফাঁক গলে আকাশ এখানে চতুষ্কোণ। এ চতুষ্কোণ আকাশেই আমরা জোছনা দেখি। এ চতুষ্কোণ আকাশেই আমরা তারা গোনার বৃথা চেষ্টা করি। এ চতুষ্কোণ আকাশটাতেই কোন কোন মা জানালার গ্রিলের ফাক গলে সন্তানকে দেখানোর চেষ্টা করেন দূষিত বাদামী চাঁদ মামাটাকে।
যে শহরটার মানুষের জীবন-যাপন প্রণালী এতটা অদ্ভুতুড়ে সে শহরের রাস্তা-ঘাট বা পাড়া-মহল্লাগুলোর নামগুলো যে স্বাভাবিক হবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। ছোটবেলা থেকেই ঢাকার রাস্তাঘাট সমূহের অদ্ভুত নামগুলো নিয়ে আমার ছিল ব্যপক আগ্রহ। ধানমণ্ডি এলাকায় গিয়ে গরুখোঁজা খুঁজেও এক মুঠা ধান পাওয়া যায় না। হাতিরঝিলে হাতি নেই,কলাবাগানে কলা নেই,কাঁঠালবাগানে কাঁঠাল নেই। মানে কি এসব নামের? এসবের মানে শেষ পর্যন্ত কিছুটা খুঁজে পেয়েছি মুন্তাসির মামুন সাহেবের ঢাকা: 'স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী' বইটাতে। নিচে তার থেকেই কয়েকটা নামের রহস্য উদঘাটন করা হল-
ইন্দিরা রোড-বেশীর ভাগ মানুষের ধারণা ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে নামকরণ করা হয়েছে রাস্তাটির। আসলে তা নয়। এককালে এ এলাকায় দ্বিজদাস বাবু নামে এক বিত্তশালী ব্যক্তি বসবাস করতেন। তার ছিল বিশাল বাড়ি। বাড়ির কাছের এই রাস্তাটি তার বড় মেয়ে ইন্দিরার নামে নামকরণ করা হয় ইন্দিরা রোড।
পিলখানা- ইংরেজ শাসনামলে যাতায়াত, মালামাল পরিবহন ও যুদ্ধের কাজে প্রচুর হাতি ব্যবহার করা হত। বন্য হাতিকে পোষ মানানো হত যেসব জায়গায় তাকে বলা হত পিলখানা। সে সময় ঢাকায় একটি বড় সরকারি পিলখানা ছিল। সরকারি কাজের বাইরেও ধনাঢ্য ঢাকাবাসীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে তাদের হাতিগুলোকে এখানে পোষ মানানোর জন্য পাঠাতে পারতেন।
এলিফ্যান্ট রোড- সে সময়ে রমনা এলাকায় মানুষজন তেমন বাস করত না। ছিল বিস্তৃর্ণ ফাঁকা এলাকা। এখানে পিলখানার হাতিগুলোকে চড়ানো হত। আর আশেপাশের খালে হাতিগুলোকে গোসল করানো হত। যে রাস্তা দিয়ে পিলখানার হাতিগুলোকে রমনার মাঠে আনানেয়া করা হত সে রাস্তাটাই আজকের এলিফ্যান্ট রোড।
রমনা পার্ক-১৮৭০ |
রমনা গেটঃ ১৯০১ |
কাকরাইল- ঊনিশ শতকের শেষ দশকে ঢাকার কমিশনার ছিলেন মিঃ ককরেল। সম্ভবত তার নামে সে এলাকায় কোন রাস্তা ছিল। সে সময় ইংরেজ কমিশনারদের নামে রাস্তার নামকরণ করার রেওয়াজ ছিলো। সেই ককরেল রোড থেকে কালক্রমে এলাকার নাম হয়ে যায় কাকরাইল।
কাগজীটোলা- ইংরেজ শাসনামলে ঢাকায় কাগজ তৈরি করা হত। যারা কাগজ তৈরি করতেন তাদের বলা হত ‘কাগজী’।কাগজীরা যে এলাকায় বাস করতেন আর যেখানে কাগজ উৎপাদন ও বিক্রি করতেন সে এলাকাই কাগজীটোলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
গোপীবাগ- গোপীনাগ নামক এক ধনী ব্যবসায়ী এই এলাকার মালিক ছিলেন। তিনি স্থাপন করেছিলেন ‘গোপীনাথ জিউর মন্দির’। তখন থেকেই এই এলাকার নাম গোপীবাগ।
চাঁদনী ঘাট- সুবাদার ইসলাম খাঁর একটা বিলাশবহুল প্রমোদতরী ছিল। প্রমোদতরীর নাম ছিল – চাঁদনী। ‘চাঁদনী’ ঘাটে বাধা থাকত। অন্য কোন নৌকা এই ঘাটে আসতে পারত না। সেখান থেকে এলাকার নাম চাঁদনী ঘাট।
টিকাটুলি- এক সময় হুক্কা টানার বেশ চল ছিল বাংলা মুল্লুকে। আর ঢাকার এই এলাকা ছিল হুক্কার ‘টিকা’ তৈরির জন্য বিখ্যাত। ‘টিকা’ তৈরিকারকরা এই এলাকায় বাস করতেন ও ব্যবসা করতেন।
তোপখানা- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গোলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান ছিল এখানে।
নবাবপুরঃ ১৮৭০ |
পুরানা পল্টন, নয়া পল্টন- এ এলাকা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ঢাকাস্থ সেনানিবাস।
ধানমন্ডি- এখানে এককালে বড় একটি হাট বসত। হাটটি ধান ও অন্যান্য শস্য বিক্রির জন্য বিখ্যাত ছিল।
পরীবাগ- পরীবানু নামে নবাব আহসানউল্লাহর এক মেয়ে ছিল। সম্ভবত পরীবানুর নামে এখানে একটি বড় বাগান করেছিলেন আহসানউল্লাহ।
পাগলাপুল- ১৭শতকে এখানে একটি নদী ছিল, নাম – পাগলা। মীর জুমলা নদীর উপর সুন্দর একটি পুল তৈরি করেছিলেন। অনেকেই সেই দৃষ্টিনন্দন পুল দেখতে আসত। সেখান থেকেই জায়গার নাম পাগলাপুল।
চকবাজার-১৯০৪ |
পানিটোলা- যারা টিন-ফয়েল তৈরি করতেন তাদের বলা হত পান্নিঅলা। পান্নিঅলারা যেখানে বাস করতেন সে এলাকাকে বলা হত পান্নিটোলা। পান্নিটোলা থেকে পানিটোলা।
ফার্মগেট- কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালন গবেষণার জন্য বৃটিশ সরকার এখানে একটি ফার্ম বা খামার তৈরি করেছিল। সেই ফার্মের প্রধান ফটক বা গেট থেকে এলাকার নাম ফার্মগেট।
শ্যামলী- ১৯৫৭ সালে সমাজকর্মী আব্দুল গণি হায়দারসহ বেশ কিছু ব্যক্তি এ এলাকায় বাড়ি করেন। এখানে যেহেতু প্রচুর গাছপালা ছিল তাই সবাই মিলে আলোচনা করে এলাকার নাম দেন শ্যামলী।
সূত্রাপুর- কাঠের কাজ যারা করতেন তাদের বলা হত সূত্রধর। এ এলাকায় এককালে অনেক শূত্রধর পরিবারের বসবাস ছিলো।
ঢাকা মাদ্রাসাঃ কবি নজরুল কলেজ |
সুক্কাটুলি- ১৮৭৮ সালে ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয়। এর আগে কিছু লোক টাকার বিনিময়ে চামড়ার ব্যাগে করে শহরের বাসায় বাসায় বিশুদ্ধ খাবার পানি পৌঁছে দিতেন। এ পেশাজীবিদেরকে বলা হত ‘ভিস্তি’ বা ‘সুক্কা’। ভিস্তি বা সুক্কারা যে এলাকায় বাস করতেন সেটাই কালক্রমে সিক্কাটুলি নামে পরিচিত হয়।
মালিবাগ- ঢাকা একসময় ছিল বাগানের শহর। বাগানের মালিদের ছিল দারুণ কদর। বাড়িতে বাড়িতে তো বাগান ছিলই, বিত্তশালীরা এমনিতেও সৌন্দর্য্য পিপাসু হয়ে বিশাল বিশাল সব ফুলের বাগান করতেন। ঢাকার বিভিন্ন জায়গার নামের শেষে ‘বাগ’ শব্দ সেই চিহ্ন বহন করে। সে সময় মালিরা তাদের পরিবার নিয়ে যে এলাকায় বাস করতেন সেটাই আজকের মালিবাগ।
0 মন্তব্যসমূহ