বেদের মেয়ে গণতন্ত্র



ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে—“Logical Fallacy”—অর্থাৎ এমন একটা কথা, যা দেখতে-শুনতে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়, কিন্তু আসলে পুরাই ধোঁকাবাজি। বিএনপি এই মুহূর্তে যা করছে, সেটা এর চেয়ে বেশি কিছু না। সকাল-বিকাল ‘নির্বাচন, নির্বাচন’ আর 'নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশ পরিবর্তন আসবে না' জপেই যাচ্ছে, যেন জনগণ নামের এক মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিলেই দেশের ভাগ্য বদলে যাবে!

এই কথাগুলো অনেকটা চানাচুরের মতো—খেতে মজা, কিন্তু পুষ্টিগুণ শূন্য। বরং গ্যাস্ট্রিক বাড়িয়ে দেবে নিশ্চিত!

এই বিএনপিই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল। পারেনি। ২০০৬ সালে সাংবিধানিক কসরত করতে গিয়ে এমন অবস্থা করল যে, পুরো দেশ হুট করে একদিন জেগে দেখল, তাদের শাসকগোষ্ঠী গেছে ক্যান্টনমেন্টের গেস্টহাউসে। এবং আজ ২০২৪ সালে এসে আবার সেই পুরনো সিডি বাজাচ্ছে—‘দেশে গণতন্ত্র নাই, নির্বাচন দরকার’।

মজা হচ্ছে, দুই দশক ধরে যারা নিজেরাই গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়েছে, তারা এখন গণতন্ত্রের ঠিকাদার হয়ে বসেছে! বিষয়টা অনেকটা সেই ছেলেটার মতো, যে স্কুলে কোনোদিন ঠিকমতো পরীক্ষা দেয়নি, কিন্তু সবাইকে পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ গাইড লাইন সে দিয়ে বেড়াচ্ছে!

এদিকে জনগণ? তাদের বিষয়ে একটু ভাবা দরকার। এই জনগণ সেই জনগণ, যারা অফিসে বসে চায়ের কাপ হাতে ফেসবুক স্ক্রল করে বসের খারাপ ব্যবস্থাপনা নিয়ে পোস্ট দেয়, কিন্তু নিজে দিনে দুই ঘণ্টা টিকটক দেখে অফিসে বসেই। যে জাতি টেলিভিশনের রিমোট হাতে নিয়ে ‘নিউজ দেখব না নাটক?’—এই সিদ্ধান্ত নিতে দশ মিনিট সময় নেয়, তারা আবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে গণভোট দিয়ে?

গণতন্ত্র নিয়ে একটা ছোট্ট সমস্যা আছে। ধরে নেন, রাস্তার দুই পাশের লোকদের হাতে ভোটের ক্ষমতা দিলেন। একপাশে বুদ্ধিজীবী বসে আছে, যে রিসার্চ করে, ধরেণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; আরেকপাশে ছোড়া বসে আছে, যে ইউটিউব শর্টসে “How to make money in 7 days” দেখে দিন কাটায়। কাজ কাম করতে বললেই তার রাজ্যের আলস্য। এখন এই দুই জনের ভোটের ওজন সমান! এটা ঠিক ততটাই যৌক্তিক, যতটা যৌক্তিক হবে কুকুরকে গণভোট দিয়ে ঠিক করতে দেওয়া, সে রুটি খাবে না মাংস!

এই কারণেই জনপ্রিয়তা দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায় না। যদি গণভোটের ভিত্তিতে সিনেমার গুণমান নির্ধারিত হতো, তাহলে “বেদের মেয়ে জোৎস্না” হতো বাংলা সিনেমার শ্রেষ্ঠতম শিল্পকর্ম, আর সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” যেত ডাস্টবিনে! বাস্তবতা হলো, মানুষ যা সহজে বোঝে, সেটাই গ্রহণ করে।

চার্লি চ্যাপলিন একবার বলেছিলেন, “Common people are a headless monster.” মানে, জনসাধারণ একটা বিশাল দানব, যার শক্তি প্রচুর, কিন্তু মাথা নেই। গণতন্ত্র কাগজে-কলমে খুব সুন্দর শোনায়, কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় বাঁদরকে প্লেন চালানোর মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সে ভুল করে দু একবার ঠিক বাটন হয়ত চেপে দেবে কিন্তু দিনশেষে সেটা দুর্ঘটনায় পড়বেই।

তাই গণতন্ত্র দরকার, তবে সেটার একটা বাফার দরকার। কারণ, একদল মানুষ বুদ্ধির জোরে সিদ্ধান্ত নেয়, আরেকদল নেয় মুঠোফোনের ডাটা প্যাকেজের মেয়াদ দেখে। এই দুই দলকে এক পাল্লায় মাপা মানে, বাঁশ দিয়ে বিল্ডিং বানানোর চেষ্টা করা। 

ফলাফল? সেই পুরনো চক্র, যেখানে আমাদের সামনে নির্বাচনের মুলা ঝুলানো হবে, সেই মুলাকে চাবাতে চাবাতে আমরা সিদ্ধান্ত নেব এবার কে আমাদের মাথার উপর ছড়ি ঘুরাবে, আর পাছায় সপাং সপাং চাবুক মারবে। আমরা নিজেদের গাধার মালিক ভেবে আত্মতৃপ্তিতে ভুগব।আসলে আমরা নিজেরাই সেই গাধা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ