অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ। যে ঘ্রাণে মিশে আছে অদ্ভুত বিষন্ন নস্টালজিয়া, শৈশবের সারল্য আর মসজিদের কার্পেটে লেপ্টে থাকা বাসি আতরের গন্ধ। আমাদের ছেলেবেলার রমজান আসত শীতের সময়, সে কি দূর্দান্ত শীত! প্রথম সেহরির সময় ঘুম ভেঙেই— যুবুথুবু ঠান্ডা হাওয়া, দূরে কোথাও ভেসে আসা আজানের সুর, আর রান্নাঘর থেকে আসা ডিম ভাজার আওয়াজ। আহা...
রমজান আসা মানেই মসজিদে হঠাৎ মানুষের ঢল। সারাবছর গা এলিয়ে শুয়ে থাকা এলাকার বড় ভাইরা সেদিন গম্ভীর মুখে পাঞ্জাবি গায়ে হাজির! মুরুব্বিদের পকেটে তসবি, মুখের গাম্ভীর্য এমন যেন জীবনে আর কোনোদিন এই দুনিয়ার দিকে তারা ফিরে তাকাবেন না। এই শেষ!
আব্বার হিসেব-নিকাশেও একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন— “সংযমের মাস, খরচ কমানো দরকার।”
অথচ ইফতারের সময় সেই সংযম কোথায় যেন হারিয়ে যেত! একটার ওপর একটা থালা, তার ওপর আরেকটা বাটি— এ এক পবিত্র বিশৃঙ্খলা! খেজুর, ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজুর নিচে প্লেটের অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতো। অধিকাংশ ইফতারই জমা হত পাড়া-প্রতিবেশীদের বাসা থেকে এসে। উপহারস্বরুপ।
তারাবির নামাজ ব্যাপারটা ছিল একটা রীতিমতো অপারেশন। আম্মা ভাবতেন, ছেলে নামাজে যাচ্ছে, বিরাট আল্লাহওয়ালা হয়ে গেছে! বাস্তবতা ভিন্ন। মূল উদ্দেশ্য রাতে ঘুরতে বের হয়ে আড্ডা দেয়া। আর যাত্রাপথে নতুন কোন বাসার বেল টিপে দৌড় দেয়া।
নামাজের লাইনে দাঁড়ানো মানেই এক গোপন যুদ্ধ— গুতাগুতি, পায়ে পায়ে কেচকি, একজন হাঁচি দিলে তার রেশে পুরো মসজিদ কাঁপিয়ে হাসাহাসি। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন ইমাম সাহেব সিজদায় যাবেন, আর পাশেরজনের টুপি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। এটা যেন এক অলিখিত প্রতিযোগিতা, কে কার টুপি 'গাপ' করে দিতে পারে।
ইফতারের আগের সময়টা তো একটা ট্র্যাজিক থ্রিলার। আম্মা তখন রান্নাঘরে দূর্দান্ত প্রতাপ চালাচ্ছেন। আব্বা টিভির রিমোট থাবড়াচ্ছেন নির্বিকার মুখে। ভাব এমন যে ভূমিকম্প নেমে গেলেও তিনি টের পাচ্ছেন না।
আমরা থাকতাম ব্যপক বিপদে। বারবার একদৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকানো— আর ৫ মিনিট… ৪ মিনিট… ৩০ সেকেন্ড… কখন আজান দেবে???
রমজানের শেষদিকে মহল্লায় ঈদ কার্ডের দোকান বসত। চকচকে কার্ডে বড় করে লেখা থাকত “Eid Mubarak”, পাশে কিছু আরবি-উর্দু টাইপ কিছু একটা লেখা, মানে জানা নেই। কার্ডেরও ছিল নানান ক্লাস, বৈষম্য। কারও কার্ড জরি-টরি দিয়ে একাকার, কারও কার্ডের মধ্যে সুগন্ধি ছড়ানো, আর বেশি বড়লোকদের হাতে মিউজিক কার্ড— খোলা মাত্রই ভেতর থেকে মিউজিক— টুনটুন… ঈদ মোবারক! এলিটদের ব্যাপার স্যাপার!
নতুন জামাটা একটু পর পর বের করে দেখা, হাত বুলানো, আবার রেখে দেওয়া। ঈদের দিন সকালে সেই ঝাকানাকা জামা পরে নিজেকে আমরা একেকজন বিরাট তালেবর ভেবে রজনীকান্ত স্টাইলে হাঁটা চলা করতাম।
রমজান আসে, চলেও যায়। আমরা একটু একটু করে বড় হই। কিন্তু সেই ইফতার বাজারের গন্ধ, মসজিদে ছেলেমানুষি, ঈদ কার্ডের উত্তেজনা আর ঈদের আগের দিনের চাপা উত্তেজনায় না ঘুমুতে পারার অনুভূতিগুলো ঠিকঠাক আর অনুভব করতে পারি না। কোথায় যেন একটা ফাঁকা বিষন্নতা জমে থাকে আজকাল বুকের কোথাও। একটা চিনচিনে বিষণ্ণতা নিয়ে মনে হয়— রমজান তো আবার আসবে, কিন্তু আমাদের সেই শৈশবের সারল্য কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে? অন্তত একটাবার? অথবা পরের রমজানটা দেখতে পাব তো? ইয়া রাব্বুল আলামিন হায়াত আছে তো পরের রমজান পর্যন্ত?
0 মন্তব্যসমূহ