ফাল্গুন বদলায়, বদলায় না আমাদের আন্দোলন

 




জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন উপন্যাসটা পড়ছিলাম সেদিন। গল্পটা একটু আলাপ করি সংক্ষেপে-


উপন্যাসটি শুরু হয় তৎকালীন ভিক্টোরিয়া পার্কে সিপাহী বিদ্রোহের নির্মম স্মৃতিবিজড়িত বর্ণনা দিয়ে। দেখা যায়, সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট পরিহিত খালি পায়ে একটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছে; মুনিম! সাথে দেখা যায় আরও অনেক শিক্ষার্থী। ভাষা শহীদদের মৃত্যুকে সার্থক করার জন্য আরও একবার আন্দোলন শুরু হল বাংলা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবিতে।


তিন দিন সর্বস্ব খালি পায়ে চলা, শহীদদের স্মরণে রোজা রাখা এবং শহীদদের স্মরণে কাল ব্যাজ পড়া; এইসব শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী। কিন্তু, স্বৈরাচারী শাসকদের তাতেও বাঁধা; তাই বন্ধ করল সকল মিছিল-মিটিং আর বেআইনি করে দেয়া হল সভা এমনকি কাল ব্যাজ পরা, আর সাথে রাজপথে স্লোগান। কিন্তু, অদম্য প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভেঙ্গে পড়ে সব নতুন আইন আর বেআইন।


১৯৫৫ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী আগের রাতে, মেডিকেল হোস্টেল, মুসলিম হল, চামেলি হাউজ, ইডেন হোস্টেল, ফজলুল হক হলের শিক্ষার্থীরা সকলেই অতন্দ্র হয়ে জেগে থাকল সারা রাত, আবার কোথাও কোথাও জটলা বেঁধে গাইতে লাগলো ” ভুলবো না ভুলবো না, ২১ শে ফেব্রুয়ারী “। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হল চারদিক; সেগুলো যেন তীরের মতো বিধে যাচ্ছিলো স্বৈরাচারী শাসকের কানে! তাই স্বৈরাচারী পুলিশ রাতেই আক্রমণ করলো মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে, গ্রেফতার করল অসংখ্য জনকে।


তারপরও, মনে অদম্য বিদ্রোহ নিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারী সকালবেলা সবাই মিলে গনজমায়েত হল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আর উত্তোলন করা হল কালো পতাকা। আর, তার পরেই সেখানে আবার হামলা চালায় বর্বর পুলিশ বাহিনী, আবার চালানো হয় গ্রেফতার, আর নিয়ে উঠানো হয় প্রিজন ভ্যানে। প্রিজন ভ্যান থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা শ্লোগান দেয় ” বরকতদের খুন ভুলবো না, শহীদদের খুন ভুলবো না, শহীদ স্মৃতি অমর হোক!”


এর মধ্যে জেলের গেটে পৌঁছে যায় প্রিজন ভ্যানগুলো, এরপর শত শত শিক্ষার্থীর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যায় ডেপুটি জেলার! তখন কেও একজন বলে উঠলো “এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব!” আর এই ভাবেই শেষ হয় উপন্যাসটি। 


উপন্যাসটির মাধ্যমে জানানো হয় ফাল্গুনের পর ফাল্গুন যাবে আর দ্বিগুণ হতে থাকবে অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এই আন্দোলন এই ফাল্গুনেই শেষ হবার নয়। এই আন্দোলন চলবেই দ্বিগুণ ভাবে। আরও প্রবলভাবে।


আজকে প্রায় ৮০ বছর পর এসেও আন্দোলন চলছে। ঠিক একই চিত্র। একই ভঙ্গি, একই আচরণ। শাসকের চেয়ার বদলেছে কেবল; অত্যাচারের ধরণটা বদলায়নি। এক সময় ছড়ি ঘুরানো হত ইসলামাবাদ থেকে এখন ঘুরানো হয় ঢাকা থেকে। কোটার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশিভাগ সুযোগ সুবিধা ভোগ করত, এখন করে সরকার দলীয় লোক আর তার পাণ্ডারা। 


ফাল্গুন বদলায়, আমাদের আন্দোলন বদলায় না। আমাদের নিপীড়িত হওয়া বদলায় না। আমাদের সস্তার মৃত্যু বদলায় না। 


আহারে দেশ আমার...আহারে....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ