বৃষ্টিতা!



আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বাড়িভর্তি মানুষজন আর আত্মীয়-স্বজন নিয়ে হুলস্থুল এক কারবার। একসাথে ঠেলা-ঠেলি, ঠাসাঠাসি করে কাঠের বাক্সে থান্ডার ইন প্যারাডাইজ, শুক্রবারের আলিফ লায়লা অথবা ঈদের ইত্যাদি অনুষ্ঠান ই ছিল আমাদের জীবনের মহৎ বিনোদন।

ও নাহ...আমার  আরেকটা গোপন বিনোদন ছিল। বকা খাবার ভয়ে যেটা লুকিয়ে রেখেছিলাম, আজীবন! এই গোপন বিনোদন টা ছিল-- ঝুম বৃষ্টির রাতগুলো! দেখা গেল মারামারি, কান্নাকাটি করতে করতে কোন এক রুমে ঘুমিয়ে পড়েছি। মামা, খালা কিংবা নানুর কাছে। (এধরণের পরিবারে সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো রুমে ছোটদের প্রতিদিন ঘুমানোর নিয়ম থাকেনা। একেকদিন একেজনের কাছে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়া।) হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো চোখে মুখে পানির ঝাপটায়।

বৃষ্টি!

ঘটনা টের পাওয়া মাত্রই আমি তীব্র উত্তেজনা নিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসতাম। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে ঘরময় মগ, বালতি, বাটি, হাঁড়ি, যে যা পারছে তাই নিয়ে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। আমাদের টিনশেডের বাড়িটাতে সাধারণের চেয়ে একটু জোরে বৃষ্টি নামলেই কেল্লা ফতে!  চাল বেয়ে পানি, রাস্তার পানি, চারদিকের দুনিয়ার সব পানি এসে জমে একাকার হতো আমাদের বাড়ির ভেতরে। তা ঠেকাতেই বাড়ি ভর্তি সবার এত আয়োজন।

এসময়গুলোতে সাধারণত ঘরে তুমুল ঝগড়া লেগে যেত। হাউকাউ, চিৎকার চ্যাঁচামেচি, ভয়ানক এক অবস্থা। কোনো এক অজানা কারণে আমি একপ্রকার চাপা উত্তেজনা অনুভব করতে থাকতাম। এই অদ্ভুত বিপদের সময়গুলোতে আমার আনন্দদায়ক এধরণের অনুভূতি আমাকে যে কতবার লজ্জিত করেছে, হিসেব নেই। কিন্তু তবু রাতের বৃষ্টির দিনগুলোতে আমি তীব্র আকাঙ্ক্ষা মনের কোণে লুকিয়ে ঘুমুতাম। ভাবতাম-- কখন পানি পড়া শুরু হবে? পড়তে পড়তে একটা সময় আর বাটি, বালতিতেও কাজ হবে না। ঘর ভেসে যাবে গোড়ালি পানিতে। বাড়তে থাকবে আরও, আরও...

বাড়ির সবাই একটা সময় পর হতাশা আর ক্লান্তি নিয়ে নিয়তির হাতে নিজেদের ছেড়ে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়বে। আর আমি বসে পড়বো কাগজের নৌকা বানানোর কাজে। আমার ঘরের ভেতর একের পর এক নৌকা ভেসে বেড়াবে। হরেক রকম নৌকা-- খবরের কাগুজে নৌকা। বোনের ডায়েরী পাতা নৌকা। টালি খাতা কিংবা পোকা খাওয়া মামার উপন্যাস নৌকা।

এখনও মাঝে মাঝে গভীর রাতগুলোতে তুমুল বৃষ্টিরা নেমে আসে আমার  কংক্রিট বাড়ির ছাতে। সে বৃষ্টির ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি অস্থির হয়ে জানালার কাছে যাই-- বন্ধ করতে হবে। কোনো এক অজানা ঘোর আমায় আটকে রাখে, বন্ধ করতে পারি না। বাইরে বৃষ্টির শব্দেরা বেড়ে চলে। নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিতে ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে চরাচর। নোংরা এ শহরের ক্লান্তি, বেদনা, আর হাহাকারগুলো যেন মুছে দিচ্ছে পরম যত্নে।

কী তুমুল, একরোখা বৃষ্টি।

বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিতে থাকে আমার মুখ, পাশের টেবল, টেবলের ওপর রাখা পাওলো কোয়েলহোকে। আমি বিড়বিড় করি-- ভিজুক। আমার ভেতরের কোথায় যেন একটা ক্ষীণ আশা জন্মাতে থাকে-- এই থাই-জানালার ফাঁক গলে আসা বৃষ্টির ছাঁটগুলো আজ ঘরটাকে ভাসিয়ে দেবে। আমি আবার সেই শৈশবের চাপা উত্তেজনা অনুভব করতে থাকি। অপেক্ষায় থাকি, এ ঘরটা একটু পর ঠিক ঠিক ভেসে যাবে, আমি নৌকা বানাতে বসে পড়বো। হরেক রকম নৌকা-- 
খবরের কাগুজে নৌকা। বোনের ডায়েরী পাতা নৌকা। টালি খাতা কিংবা পোকা খাওয়া মামার উপন্যাস নৌকা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. এই লেখাটা পড়তে আমার এত ভালো লাগে। প্রায় এসে পড়ে যাই

    উত্তরমুছুন