এমন ঘনঘোর বরিষায়...



প্রিয় স্বাতী,
"বৃষ্টি ছাড়া তোমাকে আমি কখনো লিখি না।"  
তোমার অভিযোগ সত্য প্রমাণ করতেই আজ লিখতে বসেছি। গত দুদিন যাবৎ বৃষ্টি হচ্ছে-- একঘেয়ে, একটানা। রাস্তা-ঘাটে পানি-টানি উঠে বিশ্রী অবস্থা, থলথলে কাঁদা, জুবজুবে ভেজা শার্টে ছেয়ে গেছে গোটা শহরটা। পত্রিকার ভাষায়-- "টানা বর্ষনে নাকাল শহরবাসী।" কথা ঠিক! আমি নাকাল হয়ে পড়ছি। আমি নাকাল পড়ছি এক অদ্ভুত ভালো লাগার ঘোরময় বিষন্নতায়, ঘরের জানালার কাছে থাকা গাছটার একটানা সরসর শব্দটায়, হীম করা বাতাস আর মাটির সোঁদা গন্ধটার মাদকতায়। 
জানো স্বাতী? কিছু কিছু গন্ধ আমাকে পুরোনো স্মৃতিতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় বারবার। আমি আজ পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম মাটির সোঁদা তীব্র ঘ্রাণটার প্রবাহ আমার নাক দিয়ে ঢুকে বুকের সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে...যাচ্ছে...যাচ্ছে; শেষমেশ গিয়ে অনেকটা বুকে জমাট বেঁধে থাকা কফের মতো করে বাঁ পাশটাতে জমাট বেঁধে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কি অদ্ভুত! আমার মনে পড়ে যেতে থাকলো আমার শৈশবে কাটানো লালমাটিয়ার দিনগুলোর কথা। বৃষ্টির দিনগুলোয় স্ট্যাম্প, ব্যাট সবকিছু গ্যারেজে গুছিয়ে টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলতে নেমে যেতাম রাস্তায়। কি উত্তেজনা! কি প্রবল উৎসাহ! অবশ্য আমাদের বেশিরভাগ উৎসাহ ছিল বারান্দায় দাঁড়ানো কিশোরি মেয়েগুলোকে ইম্প্রেস করার জন্যই। হা হা হা.....কি রাগ হচ্ছে খুব? কি প্রাণান্ত চেষ্টা থাকতো একেকজনের। দুর্দান্ত, ঘোরলাগা সময়গুলো। আহ!
আমি বরাবরই একটু ভাবালু টাইপের। খেলার ফাঁকের বিরতিতে কিংবা মাঝেমধ্যে অযথাই লাল রঙা ইঞ্জিনিয়ার বাড়ির চালতা গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে পানির ঝাপটাগুলো উপভোগ করতাম প্রচন্ডভাবে। অঝরধারার বৃষ্টিগুলো আমার চুল হয়ে গড়িয়ে চোখের পাতার ওপর এসে স্থির হতো, চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যেত বারেবার… সে ঝাপসা চোখের পানিগুলো হাতের তালু দিয়ে সরিয়ে দিতে যে কি এক অদ্ভূত ভালো লাগা কাজ করতো…অসহ্যকর এক ভালো লাগা!
জানো স্বাতী? আমার খুব ইচ্ছে করে ওই অনুভূতিগুলোকে ফিরে পেতে। যদি পারতাম আমার সর্বস্ব দিয়ে সে সময়গুলোকে আমি আঁকড়ে ধরতাম। এতো তীব্র করে কীভাবে আমি অনুভব করতে পারতাম সবকিছু? কীভাবে পারতাম এতো সুন্দর করে সব শুভ্র-শুদ্ধতায় সবকিছুকে সাজাতে? আমার বড্ড ইচ্ছে ছিলো তোমাকে এই বৃষ্টি-দিনের প্রতিটা সুন্দরতম অনুভূতি হাতে হাত ধরে চেনাই, চোখ বন্ধ করিয়ে অনুভব করাই আমার মতো করে। আমি এখনও খুব করে ভালোবাসি আমার এই প্রাচীন অনুভূতিগুলোকে। এই স্মৃতিগুলোর মাঝেই আমার বর্তমান বসবাস। ভালো থাকা-মন্দ থাকার বড় একটা অংশ। 
আজো ইচ্ছে করে ঠিক তেমন করে ভিজি। মনটার সাথে সাথে আমার চোখের পাতায় ঝাপসা বৃষ্টির ফোঁটা জমাই। হয় না! আমার এই সামান্য বয়সটাতেই ক্যামন করে যেন অনেকগুলো রোগ বাঁধিয়ে বসে আছি। আধঘন্টা বৃষ্টিতে ভেজা মাত্রই প্রচন্ড মাথাধরায় অন্তত দু'দিন ভুগতে হয়। গলাবন্ধ হয়ে কানে ইনফেকশন হয়ে বিশ্রী এক অবস্থা তৈরি হয়। 
নিজের অসহায়ত্বে ইদানিং মাঝে মাঝে  অজান্তেই চোখে পানি জমে যায়। এখন ঠিক বৃষ্টি না, মাঝে মাঝে চোখের জলে ঝাপসা করি চোখ দুটো। এক বৃষ্টির মতো অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আমার কত অস্বাভাবিক ছন্দ-কল্পনা–অনুভতি আর তার ব্যবচ্ছেদ। আহারে! 
সবকিছু নিমিষেই কেমন যেন ইথারে হারিয়ে গেছে। আজ সকালে অফিসের করিডোরটাতে নির্জনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে রাস্তায় অবিরত বর্ষাধারার বয়ে যাওয়া দেখছিলাম– প্রবল অসহায়ত্বে আমি অস্থির হচ্ছিলাম, বারবার...
জানি তুমি হয়ত কোনদিনই আমার এ কথাগুলো শুনতে পাবে না, জানতেও পাবে না। নাইবা শুনলে… না ই বা জানলে। এ জীবনে সবকিছু জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কথা? তোমার কথার সাথেই তো আমার কথার কোনো যোগ নেই। আর কথা কিংবা শব্দের গাঁথুনি গুছিয়ে কি ই বা লাভ বলো?   
অনেক বেশি বাঁচাল হয়েছি ইদানিং, তাইনা? বাঁচাল-বালক হয়েছি! হাহাহা… বাক্যটা খেয়াল করেছো স্বাতী? বালক বলে ফেলেছি নিজেকে! বালক বয়সটা যে পুরোনো করে শ্যাওলা জমিয়ে বসে আছি বহু-বরষা আগেই সেটা ইদানিং আর ভাবতে ইচ্ছে হয় না। তবুও ভাবতে ভালো লাগে-- চালতা গাছের নিচে সে বালক আমাকে, চুল ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে নেমে পড়া পানির ফোঁটার বালক আমাকে; আপনাকে আমি খুঁজিয়া বেড়াই, বারেবারে...হাহাহা...   
বাঁচাল না হয়ে কী করা যায় বলোতো? এই বৃষ্টির দিনগুলো আমাকে অন্যরকম করে দেয়। জানোই তো। সবসময় এখন আর চাইলেও লেখার সময় করে উঠতে পারিনা! কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে হয় আমার অনুভূতির কথাগুলো তোমায় জানাই। আমার প্রতিটা অনুভূতি, অসংখ্য পাওয়া আর না পাওয়ার গল্পগুলো তোমায় শোনাই-- প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। আমার প্রতিটা অপ্রকাশিত চিঠির পরতে পরতে আমার নৈঃশব্দগুলোর শব্দময় হাহাকার শোনাই তোমায়।
আমার স্মৃতিশক্তির কি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা তা তোমার অজানা নয়। তবু কীভাবে কীভাবে যেন অনেককাল আগে পড়া রবীঠাকুরের কয়েকটা বরষার লাইন আমার মাথার ভেতর ঢুকে গিয়েছিলো, হয়তো বরষা নিয়ে লেখা বলেই আছে। আজকের দিনে লাইনগুলো উৎসর্গ করলাম শুধুই তোমার জন্য –
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় –
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।

সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার –
জগতে কেহ যেন নাহি আর... 
জানি, এমনটা কখনো, কোনোদিন হবে না। দেখা গেল তুমি আছো, বৃষ্টি নেই। কিংবা হাহাকার করা রাজ্যের বৃষ্টি চারিদিকে, কিন্তু তুমি ই আর নেই।
অবশ্য পথপানে স্বপ্ন দেখেই চলে গেলো জীবনের অসংখ্য বরষা… হয়ত বাকিটাও এমনি করে চলেই যাবে… 
আমার স্বপ্নগুলো কেনো যেনো কখনোই পূরণ হয়না! না হোক! এ ঝিম ধরা অপূর্ণ স্বপ্নগুলোতেও এক পৃথিবী ঘোরলাগা ভালোবাসা আছে। ঠিক বলেছি না সুনয়না ? হা হা হা...
চির প্রতীক্ষায়, আমি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ