অফিস থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা পেরুলো। জুতোর ফিতাটা বেঁধে ওপরে চোখ তুলেই টের পেলাম ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে। আজ শহরের বিশেষ একটা দিন! শ্রাবণের আকাশটা অতিমাত্রায় ফকফকে; আর তার বুকে প্যারাসিটামল আকৃতির গোলগাল একটা হলদে চাঁদ ঝুলে আছে। ভয়ানক সুন্দর এক আকাশ। জগতের যে হাতে গোণা কয়টি বিষয় নিয়ে আমি অতিমাত্রায় আহ্লাদিত হয়ে পড়ি তার অন্যতম প্রধান একটি বিষয় হচ্ছে—পূর্ণিমা।
শহরের পূর্ণিমা বরাবরই আমার কাছে শো-পিস টাইপ লাগে।ডেকোরেটরের কাছ থেকে বিশেষ দিনে ভাড়া করে আনা প্যান্ডেল টাইপের ব্যাপার। বিল্ডিংয়ের ফাঁক-ফোঁকর গলে তিলো-স্পেস টাইপ লুকোচুরি খেলা দিয়েই চাঁদ তার অস্তিত্ব জানান দেবার বৃথা চেষ্টা করে যায় আমাদের কাছে।
জোছনা দেখতে হয় গাছ-গাছালিকে সাথে নিয়ে। প্রকান্ড অশ্বত্থ টাইপ গাছের ডাল-পাতার আড়াল ঠিকঠাক চাঁদটা দেখতে দেবে না, নিজের মধ্যে একটা প্রবল ঘোরময় তৃষ্ণা তৈরি হবে চাঁদটাকে ঠিকমতো দেখবার মতো, কিন্তু ইচ্ছে করেই দেখা হবে না। অসহ্য সুন্দর চাঁদের আলোগুলো তরতর করে গড়িয়ে পড়তে থাকবে গাছের প্রতিটা পাতা, প্রতিটা ডালের ফাঁক গলে। এক অদ্ভুত রহস্যময় গা ছমছমে রাত!
অথবা জোছনা দেখতে হয় ভাদ্র মাসের শান্ত-কালো নদীর মাঝ-বুকে! একটা ডিঙ্গি নৌকায় কিছুটা দূর অভিসারে চলে যাওয়া, যতটা দূর গেলে সেখান থেকে আর তীর দেখা যাবে না, ততটা দূর। চারদিকে কুচকুচে কালো পানি আর তার বুকে কুঁচকে থাকা সাদা চাদরের মতো চাঁদের আলো বেছানো। অসাধারণ দৃশ্য!
এক প্রবল হাহাকার আর নিজের তুচ্ছতার অসহায়ত্ব যে কতবার এসময় আমার চোখ ভিজিয়েছে তার হিসেব করা মুশকিল। এ পৃথিবীর বুকে এর চাইতে সুন্দর, অপার্থিব কোনো দৃশ্য আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
আজ প্রচন্ড সুন্দর একটা চাঁদ অপেক্ষা করছে আকাশে। আর আমি আমাদের জরাজীর্ণ পুরোনো বাড়িটার শহুরে ছাদে বসে নিজের দীর্ঘশ্বাস গুণছি। এই বিচ্ছিরি শহরটাতে বসবাস করে আমার একজীবনের কত সাধকে যে প্রতিনিয়ত গলা টিপে হত্যা করে যাচ্ছি তার হিসেব কেউ কী রাখে? জান্নাতে যাতে কোনো কমতি না থাকে এই আশায় বুক বেঁধে বসে থাকি, এটাই একমাত্র ভরসা, ইনশাল্লাহ। আপাতত ভাড়া করা চাঁদ দিয়েই প্রয়োজন মেটাই। শো-পিসেরও একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।
চারিদিকে ছড়ানো হাজারটা অসুন্দরের মাঝে বসে মোটামুটি বিপ্লব করে তাকে তার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে হয়। এও আর কম কিসে?
0 মন্তব্যসমূহ