অনেককাল আগে একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম। নায়ক ইউরোপের কোন এক দেশে ঘুরতে গেছে। ট্রেনে ঠিক তার পাশের সিটেই অপরূপ রূপবতী এক তরুণী এসে বসে পড়ল। সেখান থেকেই তাদের পরিচয়,খুনসুটি,প্রেম। শেষ পরিনাম সিনেমার হ্যাপি এন্ডিং এবং একটি মারদাঙ্গা মধুর মিলনের সঙ্গীত।কখনো কখনো মানুষের বাস্তবজীবন রুপালি পর্দার সিনেমার চাইতেও অনেক অনেক বেশী অদ্ভুত,কাকতালীয় কিংবা আকর্ষণীয় হয়। আমার একটা ঘটনা বলি ...
লন্ডন থেকে আমার কিছু কাজিনদের সাথে ব্রডস্টেয়ারস যাচ্ছি। সমুদ্র দেখতে। একাই বসেছি,পাশের সিট খালি। একা বসার সমস্ত বিরক্তি এক কৌটা প্রিংগেলস চিপসের উপর ওঠাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর গভীর নীল চোখ আর আগুনরঙা চুলের এক অপরূপ রূপবতী তরুণী বাসে উঠলো। এগুতো লাগলো আমার সিটের দিকে। আমি ঝট করে পেছনে তাকালাম,না পেছনে কোন সিট খালি নেই। তাহলে কি আমার পাশেই……..এক পা দুপা করে এগুতে এগুতে তরুণীটি আমার পাশের সিটে এসে একটা ঝলমলে হাসি দিয়ে,হাই জানালো!! প্রবল শীতেও আমি ঘামতে শুরু করলাম,দু' হাঁটু ঠকঠক করে একে অপরের সাথে বাড়ি খেতে লাগল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আমি কোনমতে বললাম,হ্যালো।
আমার তখন পুরোপুরিই ভ্যবাচ্যাকা খাওয়া অবস্থায়। ঘটনা কি সত্যি ঘটছে? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি? জোর করে বার দুয়েক চিমটি লাগালাম নিজের হাতে,কামড়ও লাগালাম একবার হাতের আঙ্গুলে। নাহ! ব্যথা তো লাগে। আমার স্বপ্নও তো এত সুন্দর হতে পারেনা। অসম্ভব।আমি বরাবরই মুখচোরা স্বভাবের। কখনো আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারিনা। আর সামনে বসা মানুষটা যদি কোন রূপবতী তরুণী হয় তাহলে তো কথাই নেই। খানিকটা তোতলানো শুরু করি। কি বলা যায়,কিভাবে ইম্প্রেস করা যায়। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রায় আধঘণ্টা সময় পার করে দিলাম। ঠিক তখনই মেয়েটা সামনের সিটে কাঁদতে থাকা একটা বাচ্চাকে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এসে নিজের কোলে বসালো। আগত বাচ্চাটির সাথে সাথে আমার কথা বলার বিষয়বস্তুও চলে এলো পাশের সিটে। সাহস,শক্তি সবকিছু একত্রিত করে পিচ্চির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি জানি না ঈশ্বর কেন শুধু সাদা মানুষদেরকেই নীল চোখ দেন।হিংসা লাগে। এই পিচ্চির চোখ এত সুন্দর কেন? বাক্যটা ম্যাজিকের মতো কাজ করল। শুরু হয়ে গেল আমাদের ননস্টপ কথাবার্তা। অনেক কথা হলো তার জীবন,পরিবার,তার ফেলে আসা দেশ আয়ারল্যান্ড, তার ভালো-লাগা, মন্দ লাগা এসব অহেতুক বিষয় নিয়ে। পুরো সময়টাই আমি চোখ বড়বড় করে ভেবেছি, স্বপ্ন দেখছি না সত্যিই এসব ঘটছে আমার সাথে? একটা অদ্ভুত ভালো লাগা আর ঘোরের মাঝে ক্রমেই হারিয়ে যেতে লাগলাম আমি।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ মেয়েটার একটা প্রশ্ন আমার ঘোর লাগা ভাব কাটিয়ে মোটামুটি ৫০০ ভোল্টের একটা ঝাটকা মারলো। প্রশ্নটা ছিল,ডু ইউ হ্যাভ এনি বিলিফ? আমি বললাম,হ্যাঁ, আমি মুসলিম। মেয়েটি খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থার জন্য কাজ করত। সে আমাকে খ্রিস্ট ধর্মের বিভিন্ন আকর্ষণীয় দিক, যিশু এবং তার মহানুভবতার বিভিন্ন দীক্ষা আমাকে দিতে লাগল। আমি সেসব বোরিং তত্ত্ব মুখ হা করে গিলতে লাগলাম। একটা সময় সে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বসল,”আচ্ছা তোমাদের মুহাম্মাদ কি বলেছেন ইসলামের ব্যপারে? আমি ইসলামের ব্যাপারে কিছুই জানি না।” আমি এবার মনে মনে ভাবলাম,এবার তরে বাগে পাইছি,ইসলাম কি জিনিস তোরে বুঝামু। কিন্তু, দুঃখের বিষয় হল। তাকে বোঝাতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম,আমি ইসলাম নিয়ে বলার মতো তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা। কোথা থেকে শুরু করবো,আর কোথায়ই বা শেষ করবো আমার জানা নেই। আমি এমনসব তোতা পাখির বুলি আওড়াচ্ছি যেসব বুলি প্রায় সব ধর্মেই আছে। ইসলাম কেন ইউনিক,কেন আলাদা সেটা আমি নিজেও ঠিকমতো জানি না। যার দরুন তাকে বোঝাতেও পারছি না।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, বহুদূরে একের পর এক গ্রাম, একের পর এক শহর, অথবা মানুষ সবকিছুকে পেছনে ফেলে আমাদের বাসটা এগিয়ে চলছে। আমার এ জীবনটাও এগিয়ে চলেছে ছুটে চলা এই বাসটার মতো করেই। অনেক কিছুকে পেছনে ফেলে জীবনের ২১টি সৌরবর্ষ পার হয়ে গেছে। এই ২১ বছরে কোনকিছুই এই সর্বদা প্রানবন্ত আমার কপালে দুশ্চিন্তা কিংবা অস্থিরতার ভাঁজ ফেলতে পারেনি। কিংবা প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারেনি আমার অস্তিত্ব, বিশ্বাস কিংবা আদর্শকে। কিন্তু আজ কোন এক অচেনা দেশে, অচেনা শহরে, অচেনা এক তরুণীর অতি সাধারণ গোছের এক এলোমেলো প্রশ্ন আমার সবকিছুকে এলোমেলো করে দিলো। এর কোন মানে হয়?
সত্যি বলতে কী আমি মুসলিম ঘরে জন্মেছি,আমার বাবা-মা বলেছিলেন আমি মুসলিম। তাই আমি মুসলিম। আমার মুসলিম হওয়া কেবল মাত্র কলেজ-ইউনিভার্সিটির ফর্ম পূরণে লেখা মুসলিম এবং ছোটবেলায় সুরা ফাতিহা মুখস্থ করাতেই সীমাবদ্ধ। আমি জানি না ইসলাম কেন আর পাঁচটা ধর্ম হতে আলাদা। কেন ইসলাম ইউনিক? কী আছে এতে? আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালার কী কী বলার আছে আমাকে টা আমি জানি না। কোন কিছু না জেনেই পার করে দিচ্ছি জীবনটা। মানে কী এসবের?
এর ক'মাস পরেই আমি দেশে চলে আসি। তখন রামাদান।আমার এক প্র্যক্টিসিং মুসলিম বন্ধুর সাথে ইসলাম নিয়ে চায়ের দোকানে বসে আলাপ করছি। হঠাৎ করেই আমার সেদিনকার সে বিদেশিনীর প্রশ্নের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় আমার মূর্খতার কথা। ব্যর্থতার কথা। আমি আমার সেই বন্ধুর সহযোগিতায় শুরু করি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা এবং বিভিন্ন স্কলারদের লেকচার শোনা। কোনদিন ভুল করেও পশ্চিমে মুখ না ঘোরানো আমি পরিবর্তিত হয়ে ফিরে গেলাম আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে। তার রহমতের কাছে। তার ভালোবাসার কাছে। ক্রমশ: চলার চেষ্টা শুরু করলাম তার পথে।
আমার এই কাছে আসার গল্পটা আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে যাওয়ার গল্প। সেই সত্ত্বার কাছে যাওয়ার গল্প যিনি আমাদের ভালোবেসে প্রতিনিয়ত দান করে যাচ্ছেন তাঁর অগণিত নিয়ামত।
প্রকৃতপক্ষে,আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌসুলী। তিনি যখন যাকে চান সাহায্য করেন। যখন যাকে চান করেন ধ্বংস। আমাকে হয়তো তিনি সাহায্য করেছিলেন এক অজানা অচেনা বিদেশী অবিশ্বাসী তরুণীর একটি সাধারণ প্রশ্নের দ্বারা।জীবনের এমন অনেক ঘটনা দ্বারাই তিনি আমাদের তাঁর নিদর্শন দেখান। আগ্রহী করে তোলেন তাঁর দ্বীনে ফিরে আসার জন্য। পার্থক্য শুধু এতটুকুই কেউ তার হেদায়াত কে পায়ে ঠেলে শয়তানের পথেই থাকে অবিচল। আর কেউ ফিরে যায় তারই দিকে। তার পথেই। ভালোবাসে শুধু তাকেই সবকিছুর থেকে বেশী। অনেক অনেক বেশী।
0 মন্তব্যসমূহ