রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৬

শেষ চিঠি


বিয়ের পর একুশ বছর কেটে গিয়েছে।
তিন সন্তানের বাবা এখন আমি। ব্যবসা আর ঘর-সংসার এই নিয়েই নিত্য ব্যস্ততা। বন্ধুদেরও এখন আর খুব একটা সময় দেওয়া হয় না। শত ব্যস্ততার পরেও নিয়মমত আমার মাকে আমি সময় দিতাম। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মাকে দেখতে যাওয়া,
ফোন করে নিয়মিত খোঁজ-খবর নেওয়া, এসবে ভুল হত খুব কমই।
সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবীটাকে ঘিরে দিয়েছেন মমতা আর সৌন্দর্যের এক সুবিশাল মোড়কে। আমাদের উপহার দিয়েছেন মমতাময় সুন্দর এক জীবন আর ভালবাসার প্রচন্ড ক্ষমতা। এই প্রচন্ড সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ --মা। আর ভালোবাসার ক্ষমতার সবটুকু উজাড় করে দেবার সবচাইতে বেশি হকদারও এই ‘মা’। ব্যাপারটা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতাম।
তবুও আমি ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। মায়ের সাথে যোগাযোগ কমে গেল। দেখা হয় না অনেকদিন। ফোন করি। তবে আগের মতো নিয়মিত না। সপ্তাহে একবার কি দুবার। হঠাৎ একদিন মনে হলো মায়ের প্রতি অবহেলা করে ফেলছি না তো? সাথে সাথে মাকে ফোন করলাম-- মা! চলো রাতে দুজনে একসাথে খেতে যাই।
আকস্মিক ফোন পেয়ে মা চমকে উঠলেন। এভাবে কখনো তাকে নিয়ে বাইরে খেতে যাইনি। তিনি ভাবলেন, হয়তো কোনো বিপদে পড়েছি। স্মিত হেসে আশ্বস্ত করলাম-- আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি। কিছুই হয়নি আমার। আমি শুধু তোমার সাথে খেতে চাই। তোমার আঁচলের তলায় কিছুটা সময় কাটাতে চাই। তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে জান্নাতের ছোঁয়া পেতে চাই। আর কিচ্ছু না। তাঁর কন্ঠে কিশোরীর উৎসাহ-- আচ্ছা বাবা, সন্ধ্যায় আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব। মাকে সন্ধ্যায় আনতে গেলাম। তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে। আল্লাহই জানেন কতক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখেই তার ভালোবাসার হাসি-- সবাইকে বলেছি, ছেলের সাথে বাইরে খেতে যাচ্ছি। সবাই খুব খুশি হয়েছেন। তাঁর শিশুর মতো আচরণে আমার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো।
চোখের রঙ লুকিয়ে, তাকে একটি নামীদামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলাম। মা হাত ধরে আমাকে তাঁর পাশের চেয়ারে বসালেন। আমি খাবারের মেন্যু দেখতে লাগলাম। আর মা তাঁর পূর্ণদৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলেন আমাকে। অসহ্য ভালোবাসা আর মমতার সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করার প্রাণপন চেষ্টা করলাম আমি। তুই যখন ছোট ছিলি, আমিও তোকে বাইরে খেতে নিয়ে যেতাম। আমিও ঠিক তোর মতো করেই মেন্যু দেখতাম আর তুই পাশে বসে থাকতি। কিন্তু, এখন চোখের দৃষ্টি দুর্বল হয়ে গেছে। এত ছোট লেখা আর পড়তে পারি না। কিছুটা হতাশ শোনালো মায়ের কন্ঠ।
খাওয়া শেষ করে কাউন্টারে গিয়ে বিল পরিশোধ করে এলাম। তারপর সেখানে বসেই মায়ের সাথে গল্প করলাম অনেকক্ষণ। কত কথা! ছোটবেলার কথা। বড়বেলার কথা। বেদনার কথা। পাওয়া আর না পাওয়ার কথা। পড়ে গিয়ে হাত কেটে যাওয়ার কথা। প্রথম চাকরি পেয়ে মাকে কিনে দেওয়া উপহারের কথা। এতো এতো কথার মাঝে কখন যে আবার ছোট্ট শিশু হয়ে গেলাম টেরও পেলাম না। মায়ের প্রবল ভালোবাসা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো পুরোটা সময়। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। কথায় কথায় কখন যে এতটা সময় চলে গিয়েছে বুঝতেও পারিনি। মা বললেন-- বাবা! দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি যাওয়া উচিত।
মাকে বাড়ি দরজায় নামিয়ে ফিরে ঘুরে দাঁড়াতেই বারবার মনে হচ্ছিল, বহু মূল্যবান কিছু একটা পেছনে ফেলে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি আমি কোথাও চিরকালের মতো। পেছন থেকে মা বললেন-- বাবা! একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। এরপর কখনো একসাথে খাওয়ার সুযোগ পেলে, বিলটা কিন্তু আমি দেব। মায়ের কথাটি আমার দীর্ঘক্ষণের অভিনেতা চোখ দুটোকে হার মানালো। আর কান্না চেপে রাখতে পারলো না তারা। সেই ছোট্টবেলায় পড়ে গিয়ে হাত কেটে যাবার মতো করে কাঁদতে লাগলাম আমি। অবুঝের মতো কান্না, অহেতুক কান্না, অনবরত কান্না। মাকে চুমু খেয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলাম।
এর মাত্র অল্প কিছুদিনের মাথায় মা মারা যান। তাঁর এই চলে যাওয়ায় আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। মায়ের জন্য আরও অনেক অ-নে-ক কিছু করতে চেয়েছিলাম। তিনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন, তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। সময় গড়াল। কিছুদিন পরে চিঠির বক্স খুলতেই অনেক চিঠির মাঝখানে একটি চিঠি আমার নজর কাড়ল। সেদিন যে রেস্টুরেন্টে মায়ের সাথে খেয়েছিলাম, সেখান থেকে আসা চিঠি। কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুললাম--
বাবা! হয়তো, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না। তোর আর বৌমার জন্য অগ্রিম বিল দিলাম। তোরা দুজন রেস্টূরেন্টটাতে গিয়ে আমার পক্ষ থেকে একবেলা খেয়ে নিস। সেদিন তোর সাথে খেতে গিয়ে খুব ভালো লেগেছে রে। মন খুলে কথা বলতে পেরে আরও অনেক বেশি ভালো লেগেছে। বাবা, তোকে আমি অনেক ভালবাসি।

চিঠিটা বুকে জড়িয়ে আমি কান্নায় ভেঙে পরলাম। চিৎকার করে মাকে ডাকতে থাকলাম বারবার। তিনি নেই। আর কখনো, কোনোদিন আসবেনও না। আমার মাথার এলোমেলো চুলগুলো আর কখনো তাঁর মমতাময়ী হাতের স্পর্শ পাবে না। কেনো যেন বিশ্বাস করতে পারি না। পবিত্র আয়াতের মতো করে আমি চিঠিটা আগলে রাখি। আমার পৃথিবীজুড়ে এখন এক ভয়াবহ শূন্যতা। এই শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারে না। সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরি শক্ত করে, শূন্যতা দূর হয় না। এতো সুন্দর একটা পৃথিবীটাতে কেনো এতো কুৎসিত বেদনা থাকতে হবে? কেনো এতো ভয়াবহ বিচ্ছেদ থাকতে হবে? হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের নীরবে বোঝান-- এটাই পার্থক্য, দুনিয়া আর জান্নাতের।
-বিদেশী ব্লগ থেকে ভাবানুবাদ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন