গ্রামের বাড়ি যাবার জন্য ছোটবেলায় আমার একটা লুকোনো লোভ ছিলো। জোনাক-লন্ঠন তৈরির লোভ। রাত হলেই সেজ চাচাকে সাথে নিয়ে স্কুল মাঠের পেছনের বাঁশ ঝাড়টা তে চলে যেতাম।
ইলেকট্রিসিটির কেরামতিহীন অজ পাড়া গাঁ-টার ঘুটঘুটে আঁধার উপেক্ষা করে শত শত সবুজ জোনাকি জ্বলছে বাঁশঝাড়ের এখানে-ওখানে-সবখানে। আমি তীব্র উত্তেজনায় হরলিক্সের কৌটা হাতে করে ছুটছি।
খপ করে ২-৩ টা করে জোনাকি ধরে ফেলছি, আর পাচার করে দিচ্ছি হরলিক্সের বয়ামে। সেজ চাচা তাড়াহুড়ো কর বয়ামের মুখ লাগিয়ে ফেলছেন। ১৫-২০ মিনিটের প্রচেষ্টায় আমরা মোটামুটি মানের একটা সবুজ জোনাক-লন্ঠন তৈরি করে ফেলতাম। ফেরার সময় চিন্তিত মুখে সেজ চাচার বাণী চিরন্তনী-- "জুনি হোক ধইললে হেডে বিষ করে, কইলে ত হুনবা না। কাইলগা বেয়াইন্না বুঝবা।"
"হোক পেটে বিষ। তাও ধরবো।" ঠোঁট উল্টাতাম আমি।
মশারি টানিয়ে বাবা-মায়ের সাথে শুয়ে পড়া। টেবলের উপর জোনাক-লন্ঠন। প্রবল ভয় আর মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে জোনাক-লন্ঠন দেখার সুবিধার্থে বিছানার এক পাশে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ সারারাত জোনাকির খেলা দেখা হবে। আমার জোনাক লন্ঠন। আমার খুব নিজের কিছু সবুজ তারা।
রাত বাড়ে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ে একটা সময়। কেবল আমি ঘুমাই না। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকতে থাকে বিশ্রীভাবে। সরসর শব্দে কিছু একটা চলে যায় ঘরের ওপাশ দিয়ে। টিনের ওপর টূপ-টাপ শব্দে দু'একটা পাতা ঝড়ে পড়ে হঠাৎ হঠাৎ। নিস্তব্ধ রাতটাতে আমি টানটান চোখে তীব্র অনুভূতি নিয়ে লেপের ভেতর থেকে মাথা বের করে শুয়ে থাকি। উত্তেজনায় মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলি। যেন বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস জোনাকিরা সহ্য করবে না। এক ভয়াবহ অপার্থিব সৌন্দর্য আমার সামনে। চোখ-অসহ্য করা সৌন্দর্য।
তীব্র ভালো লাগা এবং তীব্র অপরাধবোধ এক সাথে বাসা বাঁধে আমার ভেতর। ভালো লাগার কারণ-- আমার জানা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর বস্তুটা এমূহুর্তে ঠিক আমার থেকে এক হাত দুরত্বে বসে আছে। আর অপরাধবোধের কারণ-- এ জোনাকিগুলো আগামী কাল ভোর হতে হতেই সবাই মারা যাবে। আমার সৌন্দর্যের ক্ষুধা এরা মিটিয়েছে তাদের একজীবন দিয়ে। কত শতবার যে আমি বিড়বিড় করে সরি বলেছি সেকথা হয়তো জোনাকিরা কোনোদিন জানবেও না।
আমি সেদিন হেরে গিয়েছিলাম আমার স্বার্থপরতার কাছে। তাদের মুক্তির চাইতে আমার সৌন্দর্যপ্রীতিটাই আমার কাছে মহৎ ঠাওর হয়েছিল।
প্রতিবছর ঈদ আসে। হইহই করে গ্রামে যাওয়ার প্ল্যান হয়; আমার এখন আর তেমন একটা যাওয়া হয় না। যদি ভুল করে কখনো-সখনো চলেও যাই; রাতের বেলা আমি অতি সূক্ষ্ম অস্বস্তিতে ভুগতে থাকি। অপরাধীর চোখে এদিক-ওদিক তাকাই; কেন যেন আর আগের মতো এখন আর জোনাকি খুঁজে পাওয়া যায় না। গেলেও একটা কি দুটো। এদিক-ওদিক, ছাড়া-ছাড়া; এখানে- ওখানে। আমি প্রবল বিষন্নতায় গলা পর্যন্ত ডুবে থাকি। নিজেকে অপরাধী ভাবি। ভী-ষ-ণ!
হে জোনাকি...হে সুন্দর.... এই অসুন্দরের পৃথিবীতে তুমি সত্যি ই বেমানান....খুব বেশি বেমানান...
0 মন্তব্যসমূহ