মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭

খুঁজিয়া বেড়াই


সেদিন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম— আমি আমার এই জীবনে তিনটা দশক দেখে ফেলেছি— ৮০, ৯০ এবং ২০০০। প্রায় তিনটা ভিন্ন ভিন্ন দশক, ভিন্ন ভিন্ন সময়। যতই মনে মনে নিজেকে ৯০ দশকের সেই অস্থির কিশোরটা হিসেবে কল্পনা করি না কেন আর মাত্র অল্প ক’টা দিন পরেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ হিসেবে সবাই আমাকে কৃত্রিম/অকৃত্রিম সম্মান প্রদর্শন করবে। নামের শেষে যুক্ত হবে ভদ্দরনকি—‘সাহেব’ খেতাব।
জীবনের এতগুলো বছর কীভাবে চলে গেল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে বাকিটা সময়ও যে এভাবেই জাস্ট ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি নিজেকে নাম দিয়েছিলাম "মৈনিক কিশোর"। মনে মনে কিশোর যে সে ই— মৈনিক কিশোর! আমার ভেতরের দুরন্ত কিশোরটাকে কী প্রাণপণ প্রচেষ্টায় এখনও প্রতিদিন সকালে অফিসের চেয়ারটাতে বেঁধে রাখতে হয় সে খবর আমি ছাড়া পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন মানুষের কারও কাছেই নেই। কী ভয়ংকর সাধ জাগে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো করে এখনও হঠাৎই সবকিছু ছেঁড়েছুড়ে অজানা এক লঞ্চের ডেকে চড়ে বসতে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কিসসু জানি না! স্রেফ যাওয়ার জন্যই যাওয়া।
বড় হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। মেয়েটা ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। আর আমার দুশ্চিন্তার কপালে প্রতিদিন যুক্ত হয় নতুন আরেকটা চিন্তার ভাঁজ। নিজেকে ক্রমশঃ একটা একটা করে চাদরে মুড়িয়ে আড়াল করছি প্রাণপন। সবার সাথে তাল মেলানোর চেষ্টায় নিজেকেই ভরে ফেলছি অন্য একটা কিছুতে। হয়ে যাচ্ছি অন্য মানুষ। আমার আমিকে খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। একেকটা মুখোশ, একেকটা চাদরে আমি ঢাকা, আবৃত পুরোদস্তর!
মগজের পরতে পরতে নিত্যনতুন স্মৃতি; একটার ওপর একটা, তার ওপর আরেকটা। পরত জমেই যাচ্ছে এক এক করে। অথচ আমি ঠিক আগের মতই হাহাকার করি বিকেল বেলা হইহই করে ক্রিকেট খেলতে যাব বলে। লোডশেডিংয়ের রাতে পাটি পেতে ছাদের রেলিঙয়ে পা তুলে আকাশ দেখবো বলে। নতুনের প্রতি আমার ভয় চিরকালীন। ভালোবাসি পুরাতন। সবকিছু। নতুন স্মৃতিগুলোর প্রতি তাই একবুক ঘেন্না নিয়ে বেঁচে আছি। ভীষণ ঘেন্না! ভয়ানক ঘেন্না! আমার প্রতিটা নতুন স্মৃতির পরতে পরতে জমে আছে অনুভূতির দৈন্যতা, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ আর মানুষের মিথ্যে অভিনয়ের যন্ত্রণা।
একটা সময় ছিল, স্কুল থেকে ফেরা মাত্রই কোনমতে শার্টটা খুলে জুতো জোড়া শূণ্যে ছুঁড়ে ফেলে; কিশোর-রবিন-মুসায় বুঁদ হয়ে যাওয়া। তাদের সাথে বসে এক একটা রহস্য, এক একটা অ্যাডভেঞ্চারের মায়াজালে হারিয়ে যেতাম নিমিষেই। এক বৈঠকে একটা আস্ত বই গিলে ফেলে হাত কঁচলাতে কঁচলাতে মা’র কাছে যাওয়া—“আম্মু, এই মাসে আর একটা বই কিনবো কেবল। ব্যাস! আর নাহ! এই শেষ। সামনে পরীক্ষার মাস তো, আর পড়তে পারবো না।”
আর এখন মনোসংযোগ ব্যাপারটা খুঁজতে টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ উভয়েরই প্রয়োজনই পড়ে আমার। প্রমাণ? নতুন কেনা পাওয়লো কোয়েলহোর বইটাতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পঞ্চম পৃষ্ঠায় রাখা আমার বুকমার্কটা। চোখের সামনে বই খুলে নির্মম পৃথিবীটার প্রতিটা ভাঁজ থেকে নিজেকে মুক্ত করার ফন্দি আঁটতে থাকি প্রতিটাদিন, তীব্র ঘৃণা, তুলনামূলক পাওয়া-না পাওয়ার চিন্তায় ডুবে যেতে থাকি ক্রমশঃ ঝাপসা চোখে এখন স্বীকার করতেও বাঁধে না— আমার অন্তরজুড়ে বিষ, কালো কুঁচকুঁচে বিষ।
বড় হতে হতে জীবনটাই কবে শেষ হয়ে যাবে, জানিনা। আমার মনে হতে থাকে সেই বাল্যজীবনকে ঘিরে থাকি। বেঁধে রাখি। শুভ্র, লোভ- ঘৃণাহীনা কিশোর বয়সটাতেই আটকে থাকি। আমি আমার এই আজন্ম সাধের যৌবনকে ঘৃণা করি। এই যৌবন আমায় অমানুষ করে তুলেছে। নিজেকে দেখতে চাই সেই অতি সরল হাফ প্যান্ট আর ঢলঢলা টি-শার্ট পড়া ছেলেটার জায়গায়। ঝিম ধরা দুপুরে কাঁঠাল গাছের লাঠি হাতে যে নিজেকে টিপু সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিত, বিকেল বেলার ক্রিকেট আর এক টাকার পাইপ আইস্ক্রিমেই ছিল যার এক পৃথিবী সুখ; পুরোনো বাল্বকে পরম মমতায় যে জমিয়ে রাখতো লাল রঙা হাওয়াই মিঠাই খাবে বলে।
যে জীবন সলজ্জ সরলতার, যে জীবন অকৃত্রিম আবেগের; সে জীবনে দেখতে চাই নিজেকে। প্রতিটাদিন, প্রতিটা মূহুর্তে...........

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন