মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৮

নির্মম রাতকথা




জুলাই-আগস্টের এই সময়টা আমার কাছে বছরের সবচেয়ে বিশ্রী সময় মনে হয়। গুমোট একটা আবহাওয়া চারদিকে। নিশ্বাসে গরম-বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি। এই বাতাসহীন শহরে এমনিতেই ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আমরা মনকে প্রবোধ দিই; কিন্তু এই আগস্টে এসব মিথ্যে প্রবোধেও কাজ হয় না। অসহায়ের মত ঘটঘট করে ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে মনটা
কেমন নেতিয়ে পড়ে। একটা সময় মনে হতে থাকে জীবনটায় যা খুশি হোক, এভাবেই নিস্তেজ, নিথর বসে থাকবো সহস্র বছর। কিছুতেই কিছু এসে যাবে না আমার আজ।

ঘোর কাটলে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে অজান্তে ঠোঁট কেঁপে ওঠে- ইস একটু যদি বৃষ্টি হত! ঝির-ঝির বৃষ্টি। উথাল-পাথাল বৃষ্টি। কখনো গুড় গুড় করে মেঘের ডেকে যাওয়া। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যেতে থাকবে। ভয়ংকর শব্দে কানে তালা লাগার মতো কিছু মেঘের গর্জন। আর এই সেই সাথে তুমুল বৃষ্টি। যাক ভাসিয়ে নিয়ে এই নোংরা শহরটার পথঘাট। আটকে থাকি ঘরে। অচল হয়ে যাক সব। সবদিক থেকেই জীবনটা আটকে আছে, ঘরে আটকে থাকলে আর বিশেষ কি ক্ষতি?

আজ দিনের শুরুটা হয়েছিল প্রচন্ড মাথার ব্যাথা আর ঘাড়ের বেদনা নিয়ে। সাধারণত দিনের শুরুটা খারাপ হলে শেষ টা ভালো কাটে। আজ সাধারণ দিন না। এক অসাধারণ দিন। শেষটা ভালো কাটেনি। মন, মেজাজ আর শরীর কোনোটাই নিয়ন্ত্রণে নেই। কিভাবে কিভাবে যেন এই অল্পবয়সেই অসুখ বিসুখের বসতি বানিয়ে ফেলেছি শরীরটাকে। জীবনের ৩০টি বিচ্ছিরি আগস্ট পার হয়ে যাবে এ মাসেই। আয়নার সামনে দাঁড়ালে কানের বাঁ পাশ দিয়ে কিছু সাদা চুলকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখা যায়। ক্ষুদ্র এই জীবনটা একটা বিষন্ন আগস্টের মতো পার করে দিলাম।

সময়ে সময়ে যাদের একটু আপন করে পেয়েছিলাম, তাদের প্রায় সবাইই চলে গেছে দূরে। যাদের প্রবল ভালোবেসে কাছে টেনেছিলাম, তাদের প্রায় সবাইকেই হারিয়েছি প্রবল দুঃসহ বেদনা দিয়ে। হয়তো ভুল বুঝাবুঝি কিংবা অপবাদ।

আজকে রাতের বাতাসটাতে পর্যন্ত কেমন যেন মন খারাপ মন খারাপ গন্ধ। নিশ্বাসের সাথে সাথে নাক দিয়ে এই গন্ধ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে বাড়িয়ে দিচ্ছে মন খারাপের পরিমাণ। এর কোন আপাত উপশম আমার জানা নেই। গত রাতটা প্রায় নির্ঘুম কাটিয়েছি। প্রবল বিষাদ মনে চাপা দিয়ে অস্থির হয়ে এক ফোটা ঘুমের প্রার্থনা করে গেছি স্রষ্টার কাছে। আজ ভুল করিনি, প্রার্থনার সাথে সাথে দুটো রিভোট্রিল খেয়ে শুয়ে আছি প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে। সমস্যা হচ্ছে ঘুম আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
আচ্ছা, একেকটা নির্ঘুম রাত ঠিক কতটা নির্মম তা কি জানে আমার প্রিয় মানুষেরা?

ডিজিটাল হতে হতে ডায়েরিটা হারিয়ে ফেলেছি। তাই মনের অব্যক্ত অনুভূতি শব্দ দিয়ে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল আজ, খুব।

মনের ভেতরে ঠান্ডা লাগা কফের মতো জমে থাকা কথাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিলো খুব। তাই লিখছি। যা খুশি তাই।

কৈশোরে কিছু বন্ধুদের পেয়েছিলাম আপন করে– তারা আজ জীবনকে সফল করার তাগিদে নেমে গেছে যার যার মত ইঁদুর দৌড়ে। আমি আবার সে-ই একাকীত্বে। সবার থেকে হয়তো পিছিয়ে। গুমোট আগস্টের দিনে কিছু স্মৃতি সঙ্গী করে বেঁচে আছি। নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বুঝতে চাই কবে আমার মুক্তি মিলবে এই জীবনের শেকল থেকে। আমি তো ইঁদুর হতে চাইনি। একটা পারফেক্ট মানুষ হতে চেয়েছিলাম। মনের মত সাজাতে চেয়েছিলাম জীবনটাকে।

এই যে রাতটা। জহির রায়হানের ভাষায় হাজার বছরের পুরোনো রাতটা নিয়ম করে আবার আজ নেমে এসেছে। এই রাত কি জানে ঠিক কতজন প্রতিদিন এই পৃথিবীর বুকে বদলে যাওয়া সময় আর অনুভূতির বেড়াজালে আটকা পড়ে প্রবল অসহায়ত্ব নিয়ে নির্নেমেষ তাকিয়ে থাকে প্রতিটা রাতে? প্রবল আতঙ্ক নিয়ে প্রিয় মানুষটাকে হারানোর কিংবা তার বদলে যাওয়া দেখে অনুনয় বিনয় করে চলে?

সময় বদলে যায়। এক সময়ের অনুভূতি আরেক সময়ে থাকেই না। এক সময়ের মানুষ আরেক সময়ে থাকে না। কেউ কোথাও স্থায়ী না। অনুভূতি-আবেগও না। ঘৃণা-ভালোবাসাও না। মানুষের কোনো সম্পর্কের প্রকৃতিও কখনো চিরস্থায়ী নয়। তা বদলাবেই। হাজার বছরের রাতেদের মত তারা নিয়ম করে প্রতিদিন একইভাবে নেমে আসবে না। তারা বদলাবে। তার পরিবর্তিত হবে। অপেক্ষাটা কেবল সময়ের......

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন