শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭

এ কেমন বিচার?



'বেকসুর খালাস' শব্দটার ওপর আমার এমনিতেই এলার্জি আছে। এলার্জিটা আরও পাকাপোক্ত হয়েছিল ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন যখন বাড়ির গৃহকর্মীকে নির্যাতন করেও বেক্সুর খালাস পেয়ে গিয়েছিলেন, তখন। পিঠ, হাত, পা সর্বত্র কাটা-ছেঁড়া, খুনতির ছ্যাকার দাগ থাকা মেয়েটা নাকি পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিল। শাহাদাতের বিরুদ্ধে আনা সকল প্রকার অভিযোগও নাকি মিথ্যা ছিল।

এর কিছুদিন আগেই ক্রিকেটার রুবেল-হ্যাপির ঘটনা জাতি দেখেছিল। আর অল্প কিছুদিন পরেই সাব্বির রহমান, আল আমিন নামক আরও দুই ক্রিকেটার বিপিএল চলাকালীন সময়ে হোটেলে নারী কেলেংকারিতে ধরা পড়লো। সবার বিচার হলো। বিচার দেখে আমি মাননীয় স্পিকার হয়ে নিজের মনকে প্রশ্ন করলাম-- এ কেমন বিচার মনু?? এ কেমন বিসার? আজ এ তালিকায় নাম লিখিয়েছেন ক্রিকেটার শহীদ। স্ত্রী নির্যাতন-হত্যা চেষ্টার অভিযোগ। এই মালটাও যে অল্প কিছু দিন পরই বেকুসর খালাস পেয়ে যাবে কিংবা প্রহসনের বিচারে নির্যাতিত মেয়েটার জীবন বিষময় হয়ে যাবে তা হলফ করে বলাই যায়।

আজ আমরার অতি প্রিয় লিওনেল মেসির বিয়ে। কন্যা অতি ভদ্র, রুপবতী-গুণবতী। ইতিমধ্যেই মেসির সাথে তার দু সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখে ফেলেছে। দু সন্তান অতি গর্বের সহিত বাবা-মায়ের বিয়েতে আজ হাসি হাসি মুখে উপস্থিত হবে। চমৎকার ব্যাপার-স্যাপার! আমাদের নিউজ চ্যানেলগুলো বেশ ঘটা করেই এসব প্রচার করছে, যেন এটা এক অতি স্বাভাবিক ঘটনা। (আমাদের গা সয়ে যাচ্ছে দিনকে দিনে)

ভয়ের দিকটা হচ্ছে-- খেলোয়ার, নায়ক, গায়ক এরা আজকের অধিকাংশ তরুন প্রজন্মের আইডল(এ শব্দেও এলার্জি আছে)। একটা কিশোর ছেলে মেসির পায়ের ক্যারিগুরি দেখে দেখে বড় হয়। তাকে আইডল মানে, তার মতো হেয়ার স্টাইল তার মতো খেলা এমনকি তার মতো জীবনটাও চায় নিজের অজান্তেই। রাসুল(সা.) আমাদের বলেছিলেন আমরা কাফিরদের অনুসরণ করবো যেভাবে টিকটিকির লেজ গর্তের দিকে তাকে অনুসরণ করে। আমরা সত্যিই আজ সে পথটাতেই হাঁটছি। হাঁটছি বলাটা ভুল, দৌঁড়াচ্ছি।

মেসি বিয়ে না করেও সন্তান নিয়ে ঘুরতে পারে। কিন্তু তাকে দেখে এসব ঘটনাকে ডাল-ভাত ভাবা ছেলেটা যখন একটা মেয়ের পেটে বাচ্চা জন্ম দিয়ে দেয়; তখন সেই বাচ্চাটার স্থান হয় নর্দমা, কিংবা টয়লেটের কমোডে।

আমাদের এই জাতিটা যুদ্ধের জন্য পরাজিত হচ্ছে না। পরাজিত হচ্ছে দিন দিন নৈতিকতা আর আদর্শ থেকে দূরে চলে যাবার কারণে। মানসিক পরাজয় মেনে নিয়ে, এমন কিছু মানুষের অনুসরণ এই জেনারেশন করে চলেছে যাদের কোনোপ্রকার উপকারি ভূমিকা এই পৃথিবীর বুকে নেই।

এলাকার মেথর গু সাফ না করলে যে ক্ষতিটা হয়, মেসি বা শাহাদাত হোসেন ফুটবল-ক্রিকেট না খেললে সেই ছাতার ক্ষতিটাও পৃথিবীর হয় না। এরাই এই জগতের নায়ক? সিরিয়াসিলি ?

দুপুরের ঘ্রাণ


প্রিয় স্বাতী,
কখনও কি খেয়াল করে দেখেছো? মধ্য দুপুরের রোদে যে একটা গন্ধ আছে?কেমন নেশাধরা উদাসি একটা গন্ধ। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের নৈঃশব্দ্যের গন্ধটা মাথার ভেতরটা কেন যেনো এলোমেলো করে দিতে চায় বারবার। বুকের ভেতরটায় ছুরি চালিয়ে ফালি ফালি করে দিতে চায় হৃদপিন্ডটাকে।
নির্জন আবাসিক এলাকাটার গলিতে হঠাৎ হঠাৎ দু’একটা রিকশার ছন্দময় টুংটাং। গলির মোড়ের মোটর গাড়ির হুসহাস। আর ওপাশে গজিয়ে ওঠা বস্তিটা থেকে কোনো এক শিশুর শৈশব ঠেকিয়ে দিতে চাওয়া প্রৌঢ়ের হৈ হৈ চিৎকার। অথবা পেছনের মেহগনি গাছটায় নতুন বাসা বাঁধা কাকটার ছন্দময় বিরতিতে ডেকে চলা-- ক কা। এতটুকু ছাড়া সময়টা বেশ নির্জন, শুনশান, বিষন্ন!
অনেক কিছু লেখার ছিলো, বলার ছিলো। ইচ্ছে করছে না। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা। গত রাত থেকে এ যন্ত্রণা আমাকে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলতে চাইছে। আমি টানটান চোখে সাইদুরের দোকানের চা গিলি। কাজ হয় না। ভালোও লাগে না ইদানিং শরীরটার দিকে মনোযোগ দিতে। বেঁচে থাকলে মনোযোগ দিয়ে যত্ম নেবার আরও ডজন খানেক বিষয় আছে। আমার এই 'আট কুঠুরি নয় দরজাটার' দিকে ঠিকঠাক পাহারা বসানোর সময় বা সুযোগ দুটোর কোনোটাই এমূহুর্তে নেই।
নিজেকে বুঝ দিলাম, ''ভালো লাগছে না কিচ্ছু'' প্রজাতীর কথাগুলো স্রেফ আঁতলামি। বই পড়তে ভালো লাগে না, পাতা উল্টোই। আকাশ দেখতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে, দুপুরের আকাশ, ঝলমলে রোদের আকাশ। তাও হয় না। বাসায় ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে আধমরার মতো সিলিং দেখি। এই অতিপরিচিত সিলিংটার পলেস্তারা গতরাতে খসে পড়েছে, পরিস্কার করা হয়নি। থাকুক পড়ে, কি এসে যায়? এরা আমার অতি পরিচিত পলেস্তারা, থাকুক না।
অনেক কিছু লেখার ছিলো, বলার ছিলো। লিখতে বিরক্ত লাগছে। তোমার কেনা নীল রঙয়ের ভারী পর্দাগুলো টেনে দিয়ে এখন আমার পৃথিবীটা অন্ধকার করে দপদপ করতে থাকা শিরা-উপশিরাদের অনুভব করবো। আমার মৃত্যুর প্রথম রাতটাতে হয়তো, এর চাইতেও অনেক ভয়াবহ এক অন্ধকার ঘরে থাকতে হবে। আচ্ছা, তখন এই বুকটাতে অনেক আতঙ্ক থাকবে, তাইনা?
প্রশান্ত হতে হবে, যে করেই হোক। চেষ্টার সবটুকু ঢেলে দিতে পারিনি এখনও হয়তো, শিখতে হবে, পারতে হবে। না পারলে, পারার অভিনয় করে যেতে হবে।
আমার চিঠিগুলোতে কখনও বিদায় সম্ভাসন থাকে না, তুমি জানো। ক্লান্তিকর বিদায় ভালোও লাগে না। বিদায় গুলো হোক ছোট গল্পের মতো--
"শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।"
ইতি,
আমি

সোমবার, ২৬ জুন, ২০১৭

চুরি যাওয়া চাঁদ


মাগরিবের নামাজ শেষে টংয়ে বসে পোলাপান কে গভীর জীবনবোধ সম্পর্কিত লেকচার দিচ্ছি। অপু ভাইয়ের উচ্ছ্বসিত কন্ঠের ফোন-- আরমান, চাঁদ দেখসো?
চায়ের কাপে চুমুকু দিতে দিতে-- নাহ, উঠসে নাকি?
আরে মিয়া কি বলো? এত্ত বড় আর এত্ত ক্লিয়ার চাঁদ আমি জীবনে দেখি নাই। পশ্চিম আকাশে দেখো।
পশ্চিম দিক কোনটা? এইটাই তো চিনি না। (এদিকে ওদিক খুঁজতে খুঁজতে)...
ইকবাল চাচা হাত দিয়ে দিক নির্দেশ করতেই সেদিক ঘুরে উপরে তাকালাম, মনে মনে আশা-- "এত্ত বড় আর এত্ত ক্লিয়ার চাঁদটা" দেখবো। চাঁদ খুঁজে পাওয়া গেল না। সামনের ৫ তলা ছাল ওঠা বিল্ডিঙটার ৪ তলায় এক আন্টিকে দেখা গেলো। আশপাশের মানুষজন কি ভেবে বসছে আল্লাহই জানে।
গলার ভলিউম বাড়ালাম তড়িৎ-- আকাশটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পেলে দেখি, চাঁদের খবর নেবো।
আমার সারাটাজীবনের কোনো দিনই ঈদের চাঁদ দেখতে পাইনি। আশেপাশের সবাই চাঁদ দেখতে বেরোয়। আনন্দে উদ্দ্বেলিত হয়ে চাঁদ খুঁজে পেয়ে একে-ওকে জানায়। কিন্তু আমি কোনোদিনই কেন যেন চাঁদটা খুঁজে পাই না।
এটাই হয়তো জাদুর শহর ঢাকাতে বসবাস করার শাস্তি। আমাদের আকাশ টাও চুরি গেছে কখন, আমরা নিজেরাও সেটা জানি না।
যাই হোক, আকাশ ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ ঈদ। সকল বন্ধু- শত্রু, ভাই-ছোটভাই, আংকেল-আন্টি, দাদা-দাদী, নানা-নানীর প্রতি অন্তর খোলা ঈদ শুভেচ্ছা।
জগতের সকল ঈদি আমার হোক!

রবিবার, ২৫ জুন, ২০১৭

উদাসীন বৃষ্টিতা



সারাটাদিন গুমোট মেঘলা আকাশ। ঘরের ফ্যানটায় কোনো একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার গতি ধীর। এতটাই ধীরে যে এর বাতাস শরীর পর্যন্ত এসে পৌঁছে না। স্থিতি আর গতির মাঝামাঝি একটা ব্যাপার। তবু নিজেকে প্রবঞ্চনা দেবার জন্য চালু ফ্যানের দিকে মনো্যোগ সহকারে তাকিয়ে গা জুড়ানোর চেষ্টা করছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। অতি বৃদ্ধ এই ফ্যানটার দিকে কখনও সময় করে তাকানো হয়নি। আজকের গুমোট হাওয়া আর সেই সাথে ফ্যানের যৌথ স্ট্রাইক বাধ্য করলো তাকে দেখতে।
রোজাদারের দুআ নাকি কবুল হয়। বৃষ্টির দুআ করতে থাকলাম। দুআ কবুল হলো। ঝির-ঝির বৃষ্টিতে গুমোট আবহাওয়া নিমিষেই গায়েব। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। আর ঠিক এই মূহুর্তে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। তীব্র বৃষ্টির ছাঁট আমার মুখ, ল্যাপটপ সব ভিজিয়ে দিচ্ছে। ভিজুক! তবু বসে থাকবো। ভালো লাগছে খুব!
আমার টেবলটা জানালার পাশে। বৃষ্টি হলেই সেই জানালা দিয়ে মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে। অপু ভাইয়ের ভাষায়-- "এটা জিওসমিনের গন্ধ আরমান। বৃষ্টির সময় যখন এর উপর পানি পড়ে তখন বিক্রিয়া ঘটে; এর ফলে বাতাসে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। এটা মাটির গন্ধ না। মূর্খের মতো এটাকে মাটির ঘ্রাণ বলবা না। তোমরা কিছুই জানো না, কি একটা অবস্থা।"
আমি ঘাড় কাত করি-- "ঠিক, পানির মতো অতি তুচ্ছ ঘটনা। এটাও জানি না। ছিহ!"
জ্ঞানী লোকের জিওসমিন ই হোক কিংবা মুর্খ লোকের মাটির সোঁদা গন্ধই হোক। এই ঘ্রাণটা সবসময় আমাকে একটা আনন্দময় বিষন্নতায় ভোগায়। এই একজীবনে কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনার গল্প আমার এই বৃষ্টিকে ঘিরে...বলতে চাই একটা সময়, বলবো হয়তো কোনো একদিন...বাদামের ঠোঙ্গাকে সাথী করে...
একটা বই পড়ছিলাম। ভয়াবহ ট্রাজেডি। নায়কের কিডনির অবস্থা যা তা, এর মধ্যে চাকরি যাই যাই অবস্থা। মন খারাপের মাত্রা দ্বিগুন হলো। বই বন্ধ করে বাইরের বৃষ্টিতে হাত বাড়ালাম। রমাদানের আজ হয়তো শেষ দিন। তারাবীর নামাজ টা আর পড়া হবে না। মাসজিদ গুলো খাঁ খাঁ করবে তৃষ্ণার্ত মানুষের মতো। ইফতারের দাওয়াতে যাওয়া হচ্ছে না। ঈদের অপেক্ষায় থাকার অস্থির আনন্দটা আর বোধ হচ্ছে না। ক্ষমা পেয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা আর অনুভূতিটা হয়ে যাবে ভোঁতা। ঈদ আসছে এই আনন্দের চাইতে ঈদ এসে একদিনে ফুড়ুৎ করে চলে, এই ভাবনাটা আমাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলছে।
ফেইসবুক আমাকে বদলে দিয়েছে। মন খারাপের দিনগুলোর কথা একটা সময় আমার কালো চামড়ার ডায়েরিটাকে বলা হতো। এখন বলা হয় ফেসবুক আর ব্যক্তিগত ব্লগগুলোকে। নিজের বিষন্নতা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেবার মাঝে একটা পাশবিক আনন্দ লাভ আছে। আরামদায়ক পাশবিকতা।

জোনাক লন্ঠন


গ্রামের বাড়ি যাবার জন্য ছোটবেলায় আমার একটা লুকোনো লোভ ছিলো। জোনাক-লন্ঠন তৈরির লোভ। রাত হলেই সেজ চাচাকে সাথে নিয়ে স্কুল মাঠের পেছনের বাঁশ ঝাড়টা তে চলে যেতাম।
ইলেকট্রিসিটির কেরামতিহীন অজ পাড়া গাঁ-টার ঘুটঘুটে আঁধার উপেক্ষা করে শত শত সবুজ জোনাকি জ্বলছে বাঁশঝাড়ের এখানে-ওখানে-সবখানে। আমি তীব্র উত্তেজনায় হরলিক্সের কৌটা হাতে করে ছুটছি।

খপ করে ২-৩ টা করে জোনাকি ধরে ফেলছি, আর পাচার করে দিচ্ছি হরলিক্সের বয়ামে। সেজ চাচা তাড়াহুড়ো কর বয়ামের মুখ লাগিয়ে ফেলছেন। ১৫-২০ মিনিটের প্রচেষ্টায় আমরা মোটামুটি মানের একটা সবুজ জোনাক-লন্ঠন তৈরি করে ফেলতাম। ফেরার সময় চিন্তিত মুখে সেজ চাচার বাণী চিরন্তনী-- "জুনি হোক ধইললে হেডে বিষ করে, কইলে ত হুনবা না। কাইলগা বেয়াইন্না বুঝবা।"

মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০১৭

খুঁজিয়া বেড়াই


সেদিন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম— আমি আমার এই জীবনে তিনটা দশক দেখে ফেলেছি— ৮০, ৯০ এবং ২০০০। প্রায় তিনটা ভিন্ন ভিন্ন দশক, ভিন্ন ভিন্ন সময়। যতই মনে মনে নিজেকে ৯০ দশকের সেই অস্থির কিশোরটা হিসেবে কল্পনা করি না কেন আর মাত্র অল্প ক’টা দিন পরেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ হিসেবে সবাই আমাকে কৃত্রিম/অকৃত্রিম সম্মান প্রদর্শন করবে। নামের শেষে যুক্ত হবে ভদ্দরনকি—‘সাহেব’ খেতাব।
জীবনের এতগুলো বছর কীভাবে চলে গেল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে বাকিটা সময়ও যে এভাবেই জাস্ট ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি নিজেকে নাম দিয়েছিলাম "মৈনিক কিশোর"। মনে মনে কিশোর যে সে ই— মৈনিক কিশোর! আমার ভেতরের দুরন্ত কিশোরটাকে কী প্রাণপণ প্রচেষ্টায় এখনও প্রতিদিন সকালে অফিসের চেয়ারটাতে বেঁধে রাখতে হয় সে খবর আমি ছাড়া পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন মানুষের কারও কাছেই নেই। কী ভয়ংকর সাধ জাগে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো করে এখনও হঠাৎই সবকিছু ছেঁড়েছুড়ে অজানা এক লঞ্চের ডেকে চড়ে বসতে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কিসসু জানি না! স্রেফ যাওয়ার জন্যই যাওয়া।
বড় হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। মেয়েটা ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। আর আমার দুশ্চিন্তার কপালে প্রতিদিন যুক্ত হয় নতুন আরেকটা চিন্তার ভাঁজ। নিজেকে ক্রমশঃ একটা একটা করে চাদরে মুড়িয়ে আড়াল করছি প্রাণপন। সবার সাথে তাল মেলানোর চেষ্টায় নিজেকেই ভরে ফেলছি অন্য একটা কিছুতে। হয়ে যাচ্ছি অন্য মানুষ। আমার আমিকে খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। একেকটা মুখোশ, একেকটা চাদরে আমি ঢাকা, আবৃত পুরোদস্তর!
মগজের পরতে পরতে নিত্যনতুন স্মৃতি; একটার ওপর একটা, তার ওপর আরেকটা। পরত জমেই যাচ্ছে এক এক করে। অথচ আমি ঠিক আগের মতই হাহাকার করি বিকেল বেলা হইহই করে ক্রিকেট খেলতে যাব বলে। লোডশেডিংয়ের রাতে পাটি পেতে ছাদের রেলিঙয়ে পা তুলে আকাশ দেখবো বলে। নতুনের প্রতি আমার ভয় চিরকালীন। ভালোবাসি পুরাতন। সবকিছু। নতুন স্মৃতিগুলোর প্রতি তাই একবুক ঘেন্না নিয়ে বেঁচে আছি। ভীষণ ঘেন্না! ভয়ানক ঘেন্না! আমার প্রতিটা নতুন স্মৃতির পরতে পরতে জমে আছে অনুভূতির দৈন্যতা, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ আর মানুষের মিথ্যে অভিনয়ের যন্ত্রণা।
একটা সময় ছিল, স্কুল থেকে ফেরা মাত্রই কোনমতে শার্টটা খুলে জুতো জোড়া শূণ্যে ছুঁড়ে ফেলে; কিশোর-রবিন-মুসায় বুঁদ হয়ে যাওয়া। তাদের সাথে বসে এক একটা রহস্য, এক একটা অ্যাডভেঞ্চারের মায়াজালে হারিয়ে যেতাম নিমিষেই। এক বৈঠকে একটা আস্ত বই গিলে ফেলে হাত কঁচলাতে কঁচলাতে মা’র কাছে যাওয়া—“আম্মু, এই মাসে আর একটা বই কিনবো কেবল। ব্যাস! আর নাহ! এই শেষ। সামনে পরীক্ষার মাস তো, আর পড়তে পারবো না।”
আর এখন মনোসংযোগ ব্যাপারটা খুঁজতে টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ উভয়েরই প্রয়োজনই পড়ে আমার। প্রমাণ? নতুন কেনা পাওয়লো কোয়েলহোর বইটাতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পঞ্চম পৃষ্ঠায় রাখা আমার বুকমার্কটা। চোখের সামনে বই খুলে নির্মম পৃথিবীটার প্রতিটা ভাঁজ থেকে নিজেকে মুক্ত করার ফন্দি আঁটতে থাকি প্রতিটাদিন, তীব্র ঘৃণা, তুলনামূলক পাওয়া-না পাওয়ার চিন্তায় ডুবে যেতে থাকি ক্রমশঃ ঝাপসা চোখে এখন স্বীকার করতেও বাঁধে না— আমার অন্তরজুড়ে বিষ, কালো কুঁচকুঁচে বিষ।
বড় হতে হতে জীবনটাই কবে শেষ হয়ে যাবে, জানিনা। আমার মনে হতে থাকে সেই বাল্যজীবনকে ঘিরে থাকি। বেঁধে রাখি। শুভ্র, লোভ- ঘৃণাহীনা কিশোর বয়সটাতেই আটকে থাকি। আমি আমার এই আজন্ম সাধের যৌবনকে ঘৃণা করি। এই যৌবন আমায় অমানুষ করে তুলেছে। নিজেকে দেখতে চাই সেই অতি সরল হাফ প্যান্ট আর ঢলঢলা টি-শার্ট পড়া ছেলেটার জায়গায়। ঝিম ধরা দুপুরে কাঁঠাল গাছের লাঠি হাতে যে নিজেকে টিপু সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিত, বিকেল বেলার ক্রিকেট আর এক টাকার পাইপ আইস্ক্রিমেই ছিল যার এক পৃথিবী সুখ; পুরোনো বাল্বকে পরম মমতায় যে জমিয়ে রাখতো লাল রঙা হাওয়াই মিঠাই খাবে বলে।
যে জীবন সলজ্জ সরলতার, যে জীবন অকৃত্রিম আবেগের; সে জীবনে দেখতে চাই নিজেকে। প্রতিটাদিন, প্রতিটা মূহুর্তে...........

শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭

আজ আমার বদলে যাওয়াতেই আনন্দ



একটা সময় মানুষের বদলে যাওয়া দেখে খুব অবাক হতাম। কী নৃশংসভাবে সব ছিঁড়ে-ফুঁড়ে সম্পর্কগুলোকে গলা টিপে হত্যা করার ক্ষমতা রাখে মানুষ, অথবা সব আর্দ্র অনুভূতি আর স্মৃতির গতিময় রঙ্গিন সময়গুলোকে অগ্রাহ্য করে ফেলতে পারে এক নিমিষে! কতটা অবলীলায়, কতটা নির্মমতায়...

মানুষের কাছ থেকে চোখ সরাই। আমি বরং প্রকৃতি দেখি। হতবাক হয়ে আবিষ্কার করি— মন্থর থাকা ব্যাপারটাই সৃষ্টির মাঝে নেই। গাছের কচি পাতাগুলো তার রঙ বদলায়, রঙ বদলায় আকাশ, নদী তার গতিপথ, নক্ষত্র আর প্রতিটা রাত তার মায়াবী ক্ষণগুলোকে বদলে ফেলে ঠিক পরের ব্র্যান্ড নিউ দিনটাতেই।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচির বদল হয়, আর বদল হয় অনুভবের হৃদয় অথবা দেখার চোখ। পরিবর্তনকে যে যত সহজে গ্রহণ করে নিতে পারে সে তত সুখী। ভাঙা-গড়ার জীবনটার পরিবর্তনগুলো খুব সহজে গ্রহণ করে নেয়াতেই মানব জীবনের প্রশান্তি, বেঁচে থাকার আনন্দ।

প্রতিটা সৃষ্টি বদলায়, বদলায় না কেবল সপ্ত আসমানেরও অনেক উপরে বসে থাকা আমাদের স্রষ্টা। তাই ভরসা রাখতে হবে কেবল তাঁরই উপর। তিনি কেবল ভালোর জন্যই জীবনে পরিবর্তন আনেন, পরিবর্তন ঘটান।

আজ আমার বদলে যাওয়াতেই আনন্দ...বদলে যাওয়াতেই আনন্দ

সোমবার, ১২ জুন, ২০১৭

Nothing Is impossible



'Nothing Is impossible' টাইপ বিজ্ঞাপনীয় ভাষণগুলো আসলে একটি মহামারী প্রজাতির মিথ্যা কথা ৷ মানুষের নিজ সীমাবদ্ধতাই তাকে রুখে দেয় জীবনের প্রতিটি পদে পদে।
অসম্ভব সবকিছু করে ফেলা তো দূর কি বাত, মানুষ চাইলে নিজ কনুইটাকেও জিভ দিয়ে স্পর্শ করে দেখাতে পারে না। ছ'ফুট উচ্চতার মানুষটা, প্রাণপন চেষ্টা করেও নিজগুণে দশফুট উচ্চতার ছাতটা ছুঁয়ে দেখাতে পারে না। শরীরের চামড়ায় গজিয়ে ওঠা ছোট্ট ফোঁড়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না কিছুতেই। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে নিমিষেই, কিলবিল করে। মাথার চুল পড়ে টাক হয়। দোকানে,পত্রিকায়, রাস্তায় বিজ্ঞাপন ঝোলে- “টাক আজই ঢেকে যাক।’’
নিজগুণে আসলে মানুষ কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তবু মিথ্যা-মিথ্যা খেলার ফাঁদে ফেলে বোকা বোকা স্বপ্নখোর কিছু মানুষকে বেনিয়ারা শেখায় মিথ্যা স্বপ্ন দেখার কুট-কৌশল৷
মানুষ শেখেও, খুব করে।
এরপর? মানুষ মিথ্যা স্বপ্ন খেয়ে, স্বপ্ন পরেই কাটিয়ে দিতে চায় তার সত্য জীবনটা। এই স্বপ্ন-বন্দীরা একটা সময় চাকচিক্যময় মিথ্যের সাথে তিতকুটে সত্য জীবনটাকে মেলাতেও চায়, তেল-জলের মতো মেলে না কিছুতেই! এরা ক্রমশঃ হয়ে ওঠেন হতাশ আর ব্যধিগ্রস্থ!
মিথ্যা বোধ, মিথ্যা আশা, শত্রু-মিত্রের মিথ্যা পরিচয়, মিথ্যা প্রেম-প্রেম খেলা৷ অন্যের প্রাপ্তিতে নিজেকে গর্বিত মনে করার মিথ্যা প্রবোধ, অথবা মিথ্যা খেতাবের মাঝে ডুবে থেকে মানুষ তার দাম্ভিকতার সার্কাস দেখায়। নিজ পিঠ চুলকাতে না পারা ছেলেটাও আঙুল তোলে সৃষ্টিকর্তার দিকে। লড়তে চায়, স্পর্ধা দেখায় প্রতিদ্বন্দী হবার৷
টেলিস্কোপে বসে ধ্রুবতারা দেখা, আর সেখানে চলে যাওয়াটা যেমন এক নয়; তেমনি অসীমের পানে তাকানো, আর অসীম ছুঁতে পারাটাও এক নয়৷
কি দারুন ঔদ্ধত্য! সাড়ে সাত শত কোটি মানুষের পৃথিবীটাতে বাস করে, তাদের একজন হয়েও ভুলে থাকে—"আমি আর সকলের মতোই মানুষ। স্রেফ দু-হাত পাওয়ালা এক অতি সাধারণ মানুষ! সেই মানুষ যার শুরু এক ফোঁটা বীর্য থেকে। যে আজকে হাঁড়গোড়, আর আগামীর পঁচা গলা মাংসপিন্ড- যাকে কৃমি,কীট ছেড়ে গেলে কাদা হয়ে কাদাতেই মিলিয়ে যাবে, বিলীন হয় যাবে, নিঃশেষ হয়ে যাবে একবারেই!